পরিচয়ের আড়ালে
পর্ব – ৬
✍️ গিয়াস_উদ্দিন_আহাম্মাদ
রেশমী আর রফিকের আজকের রাতটি ছিল একেবারে বিপরীত অনুভূতির মিশ্রণ। একদিকে তারা গোপন তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে, অন্যদিকে জানে তাদের ওপর বড়ো বিপদের ছায়া রয়েছে।
রেশমী ঘরের দরজায় তালা দিয়ে তার ছোট্ট রুমে বসে আছে। চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস নেয়। গত কয়েক দিনের ঘটনা এখনও তার মনে দাগ কাটছে। সে একা নয়—রফিক পাশে আছে, তবে সবকিছু সহজ নয়।
রফিক বলল,
“তোমার সাথে সত্য বলতে চাই। এই গেমটা বড়। মিলন শুধু একজন নয়, ওর পিছনে বড় কোনো শক্তি আছে। আর আমরা আজকে তাদের একটা ছোট্ট অংশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছি।
রেশমী জানতে পারল, রফিক আগেই কিছু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে—যারা সমাজের বিভিন্ন স্তরে কাজ করছে। পুলিশের কিছু সৎ অফিসার, সাংবাদিক, এমনকি কিছু কলেজ শিক্ষার্থী যারা মিলনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।
“আমাদের এই জোটটা তৈরি করতে হবে,” রফিক বলল।
“একসাথে না লড়লে আমরা একা পড়ে যাব।”
রেশমী মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। তার চোখে আগুন জ্বলে উঠল।
পরের দিন রেশমী তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুকে ডেকে তাদের সতর্ক করল। প্রথমে তারা ভয় পেলেও রেশমীর দৃঢ়তায় শেষ পর্যন্ত সম্মতি জানায়।
তার সঙ্গে এক সাংবাদিক বন্ধু, দুজন পুলিশ অফিসারের পরিচয় হলো। তারা সবাই মিলনের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ শুরু করল।
রেশমীর হাতে আসা ফ্ল্যাশড্রাইভের ডেটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে মিলনের কাছে থাকা অনেক দলিল এবং ছবি ছিল। অনেকে যাদের নামও ভয় পেয়ে মুখ খুলতে পারছিল না, তাদের তথ্য সেখানে লুকানো ছিল।
এক বন্ধুর মাধ্যমে তারা এই তথ্যগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস করার পরিকল্পনা করল।
অचानक মিলনের গোপন দল তাদের অবস্থান বের করে ফেলে। রেশমী ও তার দল সরাসরি আক্রমণের শিকার হয়।
রেশমী বাঁচতে বাঁচতে গাড়িতে উঠে পালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু গাড়ির চাকা কেটে ফেলা হয়। পথরোধ করে মিলনের লোকেরা।
রেশমী ভয় পেলেও হার মানল না। রফিকের পাশে দাঁড়িয়ে সে বলল,
“তারা যত বড়ো ভয় দেখাবে, ততই আমার লড়াই আরো জোরালো হবে। আমরা শুধু আমার জন্য নয়, অন্য সবার জন্য লড়ছি।”
তারা অবশেষে পুলিশের কাছে নিরাপদ আশ্রয় পায়। রেশমী জানতে পারে, সত্যের পথে লড়াই যত কঠিনই হোক, আশা হারানো যাবে না।
রেশমীর মন এখনো সিক্ত ছিলো গত রাতে পাওয়া সেই ভয়াবহ সত্য ও গোপন তথ্য নিয়ে। মিলন শুধু একক নয়, তার পেছনে বিশাল একটি জাল গড়া হয়েছে, যাকে ভাঙতে হলে আরও সাহস, ধৈর্য আর জ্ঞান দরকার।
রফিক ও রেশমী সিদ্ধান্ত নিল, এই বৃহৎ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের সবার সঙ্গে সমন্বয় করতেই হবে। সাংবাদিকরা বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করল। রেশমীর বন্ধুরা সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা চালাল।
“আমাদের এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে,” রেশমী বলল।
“তাদের পাশে না থাকলে, পরিবর্তন আসবে না।”
মিলনের পক্ষ থেকে আক্রমণ তীব্র হলো। রেশমীর বাড়িতে হঠাৎ অচেনা লোকজন এসে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। তার বাবা-মা আতঙ্কিত, কিন্তু রেশমী ধৈর্য হারাতে পারল না।
একদিন বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রেশমী দেখতে পেলো কয়েকজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি তার গতিবিধি নজরদারি করছে। এই আতঙ্ক তাকে আরও দৃঢ় করল।
এক রাতে রেশমীর মোবাইল বাজলো। অজানা নম্বর থেকে একটি ভয়ঙ্কর ভয়ভীতি মেসেজ,
"তুমি থামালে চলবে না। তুমি যতই লড়, আমরা তোমাকে থামাবেই।"
কিন্তু রেশমীর প্রতিজ্ঞা ছিল অটুট—“আমি থামবো না, যতই বিপদ আসুক।”
একদিন হঠাৎই রেশমী একটি গোপন খবর পেল—কেউ তাকে গোপনে সাহায্য করছে। সে দেখতে পেল পুলিশ তদন্তে তার পাশে অনেক সহযোগিতা করছে।
সে ভাবল, “হয়তো সেই অজানা নাম্বারের লোকটাই এ বার সামনে আসবে।”
মিলনের লোকেরা এবার রেশমীর বন্ধুবান্ধবদের ওপর আক্রমণ করতে শুরু করল। সবাই আতঙ্কিত, কিন্তু রেশমী তাদের সাহস জুগালো।
“আমাদের একসাথে থাকতে হবে। এখন বিভাজন নয়, ঐক্য দরকার।”
রেশমীর ভাষণ সবাইকে নতুন শক্তি দিলো। তারা প্রত্যেকে নিজেদের দায়িত্ব নিয়েছে—কেউ তথ্য সংগ্রহ করবে, কেউ সমাজে সচেতনতা ছড়াবে, কেউ আবার সরাসরি লড়াই করবে।
রেশমীর চোখে জ্বলছে এক অদম্য আলো, যে আলো নিঃশেষ হবে না যতদিন সত্য জিতে না যায়।
রেশমীর হৃদয় অস্থিরতার ঢেউ খেলছিল। প্রতিদিন একটু করে বেড়ে চলা ভয়, অনিশ্চয়তা আর একগুচ্ছ প্রশ্নের জালে সে নিজেকে আটকা পড়া মনে করছিল। কিন্তু সে জানত, এখন আর পিছনে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই।
এক রাতে, একা ঘরে বসে রেশমী মোবাইলে অজানা নাম্বার থেকে আসা মেসেজগুলো বারবার পড়ছিল—“তোমার পাশে আছি,” “ভয় পেও না,” “সব কিছু প্রকাশ পাবে।”
এই অদৃশ্য সাহায্যকারী রেশমীর জীবনে এক নতুন আশা জাগিয়ে দিলো।
রফিক ও রেশমীর এক গভীর পরিকল্পনা ছিল—মিলনের গোপন আস্তানায় ঢুকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করতে হবে।
এই মিশন ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, একবার ধরা পড়লে জীবন বিপন্ন। কিন্তু তারা জানত, অন্য উপায় নেই।
রেশমী ও রফিক রাতে সাবধানে মিলনের পেছনের কার্যালয়ের দিকে এগোতে লাগল। চারদিকে ছিল সিকিউরিটি ক্যামেরা আর তীক্ষ্ণ নজরদারি।
হৃদয় ধড়ধড় করছিল, প্রতিটি শব্দ যেন অস্ত্র হয়ে দাগ কেটেছিল তাদের কানে।
হঠাৎ পেছন থেকে একটি ছায়া এগিয়ে এলো। রফিক চিৎকার না করে রেশমীর হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিলো এক গোপন সুড়ঙ্গের ভিতর।
“চুপ করো, যদি শব্দ করো, আমরা ধরা পড়ব,” রফিক ফিসফিস করে বলল।
সুড়ঙ্গের শেষে তারা পৌঁছালো মিলনের প্রধান ডাটাবেজের সামনে। রেশমীর হাত কাঁপছিল, কিন্তু একনিষ্ঠতায় সে ইউএসবি ড্রাইভ প্লাগ ইন করল।
ততক্ষণে বাইরে দুই-তিনজন মিলনের লোক তাদের খোঁজে বেড়াচ্ছিল।
ডেটা ডাউনলোড শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তারা পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সিকিউরিটি গার্ড ধাওয়া শুরু করল।
রেশমী ও রফিক দ্রুত দৌড়ে নিরাপদ পথে, ঘন ঘন গুমোট শব্দ, হৃদয়ের স্পন্দন।
হঠাৎ গার্ডের একজন রেশমীর দিকে ছুটে এসে তাকে থামানোর চেষ্টা করল। রেশমী হাত জোরে ধাক্কা মারল আর পালানোর সুযোগ পেল।
“তুমি একা নয়, আমি আছি,” রফিক কণ্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে বলল।
রেশমী বাড়ি ফিরে এসে নিজের রুমে বসে পড়ল। মনে হচ্ছিল সে এক অদম্য যোদ্ধা। চোখের পলকে অশ্রু এসে গিয়ে বুকে আটকে গেলো।
“আমি পারব, আমার জন্য নয়, আমার দেশের জন্য,” সে নিজের সঙ্গে বলল।
রেশমীর শরীরে এখনও দৌড়াচ্ছিল সেদিন রাতের শিহরন। তবে তার মনে দৃঢ় সংকল্প ফুটে উঠেছিল—যে কোনো মূল্যে মিলনের গোপন মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
পরদিন সকালে, রেশমীর মোবাইলে একটি অজানা নম্বর থেকে ফোন এলো।
"তোমার কথা থামাতে পারিনি... এবার শেষ সতর্কবার্তা," এক কণ্ঠস্বর ফিসফিস করল।
রেশমী জানল, শত্রুরা একেবারে নীচে নামে। কিন্তু সে ভয় পায়নি, বরং জ্বলে উঠল প্রতিহিংসার আগুন।
রফিকের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলো। রফিক বলল, "তুমি খুব বেশি ঝুঁকি নিচ্ছো, আর কিছুদিন অপেক্ষা কর, আমরা সবকিছু ভালোভাবে সাজাবো।"
রেশমী উত্তর দিল, "অপেক্ষা? আর কত ক্ষতি হবে? লোকেরা জানার অধিকার পায়নি এখনও।"
তাদের মধ্যে মতবিরোধ তীব্র হলো, কিন্তু উভয়েই চেয়েছিল প্রকৃত সত্য সামনে আসুক।
রেশমী সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরছিল, পথেই তার দেখা হল এক অজানা মুখের সঙ্গে—একজন যুবক, যার চোখে মায়ার ছাপ।
"আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই," সে বলল।
রেশমী প্রথমে সন্দেহ করল, কিন্তু যুবকের চোখের সৎ ভালোবাসা তাকে ভরিয়ে দিলো।
জীবনে এই প্রথম কেউ তাকে এমন সান্ত্বনা দিল, যিনি শুধু কথা বলেনি, কাজ করতেও আগ্রহী। যুবকের নাম ছিল সাইফ। সে প্রমাণ করল তার সহায়তার হাত ছেড়ে দেবে না।
রেশমী, রফিক আর সাইফ মিলে নতুন পরিকল্পনা করল—একটি বড় গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার, যেখানে তারা মিলনের ষড়যন্ত্র উন্মোচন করবে।
তারা জানত, এটি জীবনের ঝুঁকি নিতে হবে, কিন্তু সত্যের জয় ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
রেশমী একা বসে তার ভবিষ্যতের চিন্তা করছিল। হঠাৎ মেসেজ এল—
"সতর্ক থাকো, শত্রুরা এখন তোমার চারপাশে।"
তার বুক দ্রুত ধড়কছে, তবে মাথা নিচু করলো না।
পরের দিন প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গেলো। লাখো মানুষ রেশমীর পাশে দাঁড়ালো।
কিন্তু মিলন ও তার দোসররা এলো আরও বড় ছত্রভঙ্গ করতে।
রেশমীর জীবন আর তার আশেপাশের সবাই ঝুঁকিতে পড়লো।
সাইফের সাহসিকতায় রেশমী দ্রুত পরিকল্পনা করল একটি নিরাপদ স্থান খুঁজে নিতে।
তারা জানতো, সত্যকে আটকানো সম্ভব নয়, কিন্তু নিরাপদে থাকতে পারাটাই এখন সবচেয়ে বড় জয়।
চলবে.....
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন