নরপিচাশ ফুফি পর্ব ৩(শেষ)

 নরপিচাশ ফুফি 

পর্ব ৩(শেষ)



ডাক্তার রিয়াকে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়ার পর সবাই ব্যস্ত, কিন্তু একজনকে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না মায়া। এত বড় ঘটনায়ও সে হাসপাতালে আসেনি।

নীলা বারবার আরিফকে বলছে, তুমি যদি বিচার না করো, আমি আইনের সাহায্য নেব।

তোমার বোন কিভাবে আমার মেয়ের সাথে এত জঘন্য কাজ করতে পারে? তুমি তো ওকে এত ভালবাস!

কিভাবে, কিভাবে, কিভাবে?

নীলা আর সহ্য করতে পারল না, অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পড়ে গেল। নার্স এসে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিল।

জ্ঞান ফিরেই বলল, দেখছো তোমার বোন কত নিষ্ঠুর? আমার মেয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে, আর সে দেখতেও আসল না!

আমি মায়াকে ছাড়ব না। তুমি বাধা দিলে তোমাকেও ছাড়ব না। ভুলো না তুমি আমার স্বামী!

আরিফ বলল, তোমার কিছু করতে হবে না। ওর জন্য আমি কি করিনি? আমারই মেয়ের সাথে এ কাজ!

নীলা কাঁদতে কাঁদতে অপারেশন রুমের সামনে আল্লাহকে ডাকতে লাগল, আল্লাহ, তুমি আমাকে নিয়ে যাও, আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখো।

শাশুড়িও কাঁদছেন। দশ বছর পর যখন রিয়া জন্মেছিল, মনে হয়েছিল আকাশ থেকে পরী নেমেছে। তিনি নীলাকে সান্ত্বনা দিলেন, বৌমা, টেনশন করো না। আমাদের রিয়া ফিরে আসবে।

যে এ কাজ করেছে, তাকে খুঁজে বের করব। এমন শাস্তি দেব যে আর কখনো এমন করবে না।

নীলা ভাবল, আম্মা, এ কাজ তোমারই মেয়েই করেছে। কিন্তু বলতে পারল না।

শাশুড়ি জিজ্ঞেস করলেন, মায়াকে দেখছি না? কল করো তো?

মায়ার কল রিসিভ করল। শাশুড়ি বললেন, "তুই কোথায় রে? এখনো হাসপাতালে আসিসনি?

তোর আদরের ভাইঝি মৃত্যুর সাথে লড়ছে!

মায়া বলল, মা, আমার কাজ আছে। দ্রুত আসছি।

তোর কাজ আমার নাতনির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? সবাই কাঁদছে, আর তুই কাজ নিয়ে আছিস?

তোর ভাই তোর জন্য কত কিছু করেছে! তার খরচে তুই পড়ছিস।

তোর ভাবি দুইবার অজ্ঞান হয়েছে। তোর ভাইয়ার মুখ দেখতে পারছি না।

আমার বাসায় না যেতে হয়! যদি যেতেই হয়, তাহলে তোর খবর আছে!

শাশুড়ি কল কেটে দিলেন।

ডাক্তার অপারেশন শেষ করে বেরোলেন। সবাই ছুটে গেল।

নীলা জিজ্ঞেস করল, আমার মেয়ের কি অবস্থা?

ডাক্তার বললেন, আলহামদুলিল্লাহ অপারেশন সফল। কিন্তু একটা দুঃখের সংবাদ আছে।

সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে শুনল।

ক্ষত এত বেশি যে এই মেয়ে কখনো মা হতে পারবে না।

কিন্তু এই কথা কাউকে বলবেন না। বিশেষ করে মেয়েটা যেন না জানে।

খবর শুনে সবাই আল্লাহকে ডাকতে লাগল, "আল্লাহ, আমরা কি অন্যায় করেছিলাম?

নীলা জিজ্ঞেস করল, কখন মেয়ের সাথে দেখা করতে পারব?

ডাক্তার বললেন, জ্ঞান ফিরতে সকাল হয়ে যাবে। আপনারা বাইরে বিশ্রাম নিন।

আমার জীবনে এত ছোট মেয়ের এমন অপারেশন আর করিনি। অপারেশন করতে গিয়ে আমারও কান্না পেয়েছে।

যে এ কাজ করেছে, আল্লাহ তার শাস্তি দেবেন। আপনারা যা করতে চান, করুন।

ডাক্তার কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন।

নীলা আর থামতে পারল না, মাথা দেয়ালে ঠুকতে লাগল। আরিফ এসে থামাল।

তুমি ভেঙে পড়ো না। আমরা বিচার করব!

মাথা ঠোকার সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে মায়ার নাম বেরিয়ে গেল। শাশুড়ি শুনে ফেললেন।

শাশুড়ি কিছু বলতে যাবেন

আরিফ বলল, আম্মা, কিছু হয়নি।

আরিফ, তুই কখনো মিথ্যা বলিস না। বৌমা কি বলছিল? মায়া কি করেছে, সত্যি বল?

আরিফ আর লুকাতে পারল না। বলল, কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। এত বড় সমস্যা, তোমাকে বলা উচিত

এই ঘটনার সাথে জড়িত আমারই বোন মায়া।

শাশুড়ি চমকে গেলেন। "কি বলছিস আরিফ? তোর মাথা ঠিক আছে?

হ্যাঁ আম্মা, ঠিক আছে। আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইনি। যখন রিয়া বলল, আর নীলা বলল, আমিও বিশ্বাস করতে পারিনি।

যে বোন পর্দায় চলে, মাদ্রাসায় পড়ে, সে কিভাবে এমন করতে পারে?

আম্মা, তোমার মত আমিও চমকে গিয়েছিলাম।

আমাদের তিনটি রুম। আমরা একটিতে, তোমরা একটিতে, মায়া একটিতে।

রিয়ার বয়স ছয় বছর, তাই সে মায়ার সাথে ঘুমাতে যায়।

রিয়া খুব নম্র মেয়ে, কখনো মিথ্যা বলে না। যখন মায়া এমন করতে লাগল, রিয়া প্রথমে চুপ করে রইল।

যখন বেশি হতে লাগল, তখন সে নীলার কাছে এসে বলল। নীলা আমাকে বলল। আমি প্রথমে ভাবলাম ভুল হতে পারে, কাউকে বলো না।

এর মধ্যেই এত বড় ঘটনা ঘটে গেল।

আরিফ নিশ্চুপ হয়ে গেল। শাশুড়ি বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেলেন।

আমারই পেটে কিভাবে এমন নরপিচাশ মেয়ে জন্মাল?

কত আদর যত্ন করে বড় করেছি। যখন যেটা চেয়েছে, সেটা দিয়েছি।

আমার মেয়ে মায়া এমন করতে পারে, বিশ্বাস হচ্ছেনা।

আম্মা, আমিও বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু তুমি তো জানো, আমাদের রিয়া মিথ্যা বলে না।

সেটা জানি। আমার নাতনি আমার মতই সত্যি কথা বলে।

এর বিচার হবে। আগে রিয়া জ্ঞান ফিরুক, তারপর যা করতে হবে, করব।

আরিফ ও নীলা শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গেল।

শাশুড়ির চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। "এমন মেয়ে যেন আর কারো পেটে না হয়।

আরিফ ও নীলা বোঝাতে লাগল, আম্মা, টেনশন করো না। হয়তো ভুল করেছে। ডিজিটাল যুগ, বন্ধুদের সাথে মিশে নষ্ট হয়েছে।

আমি আমার বোনকে চিনি। নিশ্চয়ই কারো প্রভাব পড়েছে। আমরা খুঁজে বের করব।

মায়া আগে ফোন চালাতো না। বলত, ভাইয়া, ফোন দিয়ে কি করব?' আমি জোর করে কিনে দিয়েছিলাম।

হ্যাঁ আরিফ, আমার মনে আছে।

কথা বলতে বলতে সকাল হয়ে গেল। কেউ ঘুমায়নি।

নার্স ডাকল, রিয়ার পরিবার, আপনারা আসতে পারেন।

নীলা ছুটে গেল। রিয়া জিজ্ঞেস করল, আমি এখানে কেন?

নীলা বলল, তোমার ব্যথা হচ্ছিল, তাই হাসপাতালে আনা। তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে।

রিয়া সবাইকে দেখে খুশি হল। দাদীকে জিজ্ঞেস করল, দাদী, আমি কি ঠিক আছি?

দাদী কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তোর কিছু হয়নি। আমরা তোর পাশে আছি।

রিয়া বলল, দাদী, কাঁদো না। আল্লাহ আমাকে দ্রুত সুস্থ করে দেবেন।

দাদী বললেন, আমার পাগলী মেয়ে।

রিয়া জিজ্ঞেস করল, দাদী, ফুফিকে দেখছি না? সে কি হাসপাতালে আসেনি?

দাদী বললেন, ওরকম কুলাঙ্গার না আতাই ভালো।

রিয়া বলল, দাদী, তুমি কিছু বলছ না কেন?

না দিদি, তোমার ফুফি এখনো আসেনি। তবে আসবে।

নীলা রেগে বলল, তোমার ফুফি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ভুলে গেছ কি হয়েছে? আজ তুমি মৃত্যুর সাথে লড়েছ কার জন্য?

তোমার ফুফি মায়ার জন্য। আমি তার নাম শুনতেও চাই না।

শাশুড়িও রেগে বললেন, "সত্যিই বলেছে তোমার আম্মু।

আজ থেকে মনে করবে, তোমার কোন ফুফি নেই।

এমন সময় ডাক্তার এসে বললেন, আপনারা কি শুরু করেছেন? মেয়ের অপারেশন হয়েছে, ভুলে গেলেন?

পেশেন্টের সাথে বেশি কথা বলবেন না। টেনশন দেবেন না।

আমি এত ছোট বাচ্চার এমন অপারেশন আর করিনি। অপারেশন করতে গিয়ে আমারও কান্না পেয়েছে।

আপনাদের অনুরোধ, জোরে কথা বলবেন না। যদি আবার অজ্ঞান হয়, জ্ঞান ফেরাতে কষ্ট হবে।

ডাক্তারের কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল।

নীলা জিজ্ঞেস করল, ম্যাডাম, কখন বাড়ি নিয়ে যেতে পারব?

ডাক্তার বললেন, আপনারা বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু অতিরিক্ত চাপ দেবেন না। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। বিশ্রাম দরকার।

আমার জীবনে এমন অপারেশন এই প্রথম। দোয়া করি, রিয়া যেন দ্রুত সুস্থ হয়।

আরিফ ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল।

শাশুড়ি বললেন, বৌমা, মায়াকে কল দাও।

নীলা বলল, আমরা এখনই বাসায় যাচ্ছি, ওনার জন্য কল কেন দেব?

একটা কল দাও। ওর সাথে আমার অনেক হিসাব বাকি।

আম্মা, আপনি চুপ থাকুন। বাসায় গিয়ে ব্যবস্থা নেব।

শাশুড়ি রেগে বললেন, তোমার কিছু করতে হবে না। যেহেতু আমার মেয়ে, আমি করব।

এত বেয়াদব কোথা থেকে হল, জানতে হবে।

নীলা বলল, আপনার যেটা ভালো লাগে, করুন। কিন্তু বিচার অবশ্যই হবে।

আরিফ বলল, আম্মা, কঠোর বিচার করতে হবে। আজ আমাদের পরিবারে ঘটেছে, কাল অন্য কারো সাথে হলে মানসম্মান যেত।

হ্যাঁ আরিফ, টেনশন করো না। আমি বিচার করব।

বাড়িতে এসে দেখল, মায়া ফোন নিয়ে ব্যস্ত।

শাশুড়ি সরাসরি তার রুমে ঢুকে গালে থাপ্পর মারতে লাগলেন। তোর মত কুলাঙ্গার আমি কিভাবে পেটে ধরেছিলাম!

তুই কার সাথে কি করেছিস জানিস?

মায়া কিছু বলল না। সব বুঝতে পেরেছে।

নীলাও বলল, আমি তোমাকে ছোট বোনের মত দেখতাম। তুমি কেন আমার সাথে এ সর্বনাশ করেছিলে?

তোমার কি ক্ষতি করেছিলাম?

তোমার কারণে আমার মেয়ে মৃত্যুশয্যা থেকে বেঁচে এসেছে, কিন্তু কখনো মা হতে পারবে না!

নীলা থাপ্পড় মারল।

শাশুড়ি বললেন, মারো বৌমা, মারো!

মায়া বলল, আমি বুঝতে পারিনি এতদূর যাবে। আমি সত্যি ভুল করেছি। আমাকে মেরে ফেলো!

আমার ভাইঝির সাথে এ কাজ করা ঠিক হয়নি। আমি অনুতপ্ত।

আরিফ বলল, তোর জন্য কি করিনি? তোকে দুধ-কলা দিয়ে বড় করেছিলাম!

রিয়া বলল, তোমরা আর মারো না মায়াকে। প্লিজ!

দাদী বললেন, তুই চুপ কর রিয়া। মায়া এখনই এই বাড়ি থেকে বের হবে।

কোথায় যাবে, কি করবে, জানি না। এখন থেকে ভুলে যাব আমার কোন মেয়ে নেই। এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।

আরিফ, মায়াকে এখনই বের করতে বল।

আরিফ চুপ হয়ে রইল। সে ছোটবেলা থেকে বাবা হারিয়েছেন, সংসারের দায়িত্ব তারই।

রিয়া বলল, তোমরা যদি মায়াকে বের করে দাও, আমিও চলে যাব। তোমরা বুঝতে পারবে না।

মায়া ভুল স্বীকার করেছে। তোমরা তাকে মারছো, কষ্ট দিচ্ছো।

নীলা বলল, তুমি ছোট মানুষ, এসব কথা বলো না। সে তোমার কত বড় ক্ষতি করেছে, জানো না।

দাদী বললেন, দেখ মায়া, এই মেয়েটার ক্ষতি করেছিস, আর সে তোর সাপোর্ট করছে।

সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল। শাশুড়ি বললেন, "মায়াকে আর পড়ানো যাবে না। ওর জন্য ছেলে দেখ।

আরিফ তার বন্ধুর ছোট ভাইকে প্রস্তাব করল। ছেলে পক্ষেরা এসে মায়াকে দেখল। পছন্দ হল, বিয়ের দিন ঠিক হল।

বিয়ের কিছুদিন পর মায়া বাড়ি এল। সবার পা ধরে মাফ চাইল। রিয়াকে জড়িয়ে কাঁদল।

আমার লক্ষ্মী আম্মু, তোমার সাথে আমি অনেক খারাপ করেছি। আমাকে মাফ করে দিও।

রিয়া বলল, তুমি আমার ছোট আম্মু মনে করো, কখনো ফুফি মনে করিনি।

মায়া বলল, আমার পাগলী মেয়েটা।

এই গল্প থেকে শিক্ষা আপনার বাড়িতে যদি মেয়ে বা বোন থাকে, সময়মতো তাদের যত্ন নিন। খেয়াল রাখুন তারা কোথায় যায়, কি করে, মোবাইলে কি দেখে। পর্নোগ্রাফি থেকে সাবধান! এটি একজন সাধারণ মানুষকেও খুব দ্রুত খারাপ পথে নিয়ে যেতে পারে।

আজ যেমন রিয়ার সাথে ঘটল, কাল আপনার বাড়ির কারো সঙ্গে এমন ঘটতে সময় লাগবে না!

সমাপ্তি




0 Post a Comment:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন