তন্ত্র যুদ্ধে রক্ত বাসর পর্ব ২ গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ

তন্ত্র যুদ্ধে রক্ত বাসর

পর্ব ২

গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ 


ডালির কথা শুনে আমি প্রথমে থতমত খেয়ে গেলাম।


— “কি বললে? কেউ বলেছে? কে?”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশে তাকালাম।

গা ঘিনঘিনে অন্ধকারে কিছুই স্পষ্ট বোঝা যায় না।

একটা দেওয়ালঘড়ির কাঁটা কাঁট কাঁট করে সময় গুনছে—

তবুও যেন এই ঘরের বুকে সময় থেমে গেছে।


ডালি শক্ত করে আমার বাহু চেপে ধরলো।

ওর চোখ দুটো ততক্ষণে পানি আর ভয়ে ভারী হয়ে উঠেছে।

"আমি শুনেছি... আমি কানের কাছে একটা মেয়েলি গলা শুনেছি,"

— ওর কণ্ঠে কাঁপন, গলায় নিঃশ্বাস আটকে আসছে,

"সে বললো, 'তুমি আমার ছিলে, এখন কেন অন্য কাউকে ভালোবাসো?'"


আমার হৃদপিণ্ড যেন হঠাৎ এক ছন্দ ফেলে দুলে উঠলো।


— “ডালি, এটা তোমার কল্পনা। ভয় পেয়েছো তাই এমন শুনছো। হয়তো টিকটিকি কিংবা বাইরের গলায় প্রতিধ্বনি।”

আমি জোর করে হাসলাম, ওকে আশ্বস্ত করার ভান করলাম।

তবু সত্যি কথা, আমার নিজের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে।


ঘরের এক কোনায় রাখা আয়নাটা যেন অন্ধকারের মধ্যেও কিছু বলছে।

আমি ওদিকে তাকাতেই কেমন যেন ঝাপসা… যেন আয়নার ভেতর কেউ এক ঝলক তাকিয়ে হাসলো—তীক্ষ্ণ নারকীয় হাসি।


আমি আর থাকতে পারলাম না।


📿 **“বাবা মা’র নাম মুখে আনলাম। কাঁধ থেকে সাদা তোয়ালে টেনে নিয়ে দ্রুত বাতি খুঁজতে লাগলাম। ব্যাটারি লাইটটা ঠিকই ছিল, কিন্তু তা জ্বালাতেই লাইট দু’বার ফ্ল্যাশ করে নিভে গেল!”**


ডালির কাঁধে মাথা রেখে আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম।


— “শোনো, আমরা কিছুক্ষণ নিচে যাই, পিসিমার ঘরে আলো জ্বলছে কি না দেখি।”

— “না না! আমি একা চলতে পারবো না!”

ডালি কেঁপে উঠলো।


আমি ওর হাত ধরলাম, ধীরে ধীরে দরজা খুললাম।


**ঘরের বাইরে বের হতেই শিউরে উঠলাম — আমাদের ঘরের সামনে মেঝেতে গাঢ় লাল কিছু ছড়িয়ে আছে!**


সন্ধ্যার ফুল? না…

আমার কণ্ঠ শুকিয়ে এল…


**সেইটা রক্ত! স্পষ্টভাবে কেউ আঙুল দিয়ে মেঝেতে লিখে রেখে গেছে –

“তুমি আমার ছিলে... ভুলে গেলে?”**


ডালি চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।

আমি স্তব্ধ! হঠাৎ সেই মুহূর্তে পিছন থেকে দরজা ‘ঠাস!’ করে বন্ধ হয়ে গেল।


🔒 আমরা আবার সেই ঘরে,

তবে এবার শুধু আমরা দু’জন না —

**ঘরে আছে আরও কেউ…**


ঘরের দরজাটা এমনভাবে বন্ধ হলো, যেন কেউ ঠেলে দিল ভিতর থেকে।

আমার মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল।

ডালি কেঁপে উঠলো। হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো আমার।

ঘরে তখনো আঁধার, শুধু বাইরের ম্লান আলো জানালার কাঁচ ছুঁয়ে আসছে।


আমার চোখ চলে গেল বিছানার পাশের আয়নাটার দিকে।


সেই আয়নাটা...


আগেও দেখেছিলাম, কিন্তু তখন মনে হয়নি এতটা অদ্ভুত।

এবার যেন সেটার ভিতর অস্বাভাবিক কিছু দেখা যাচ্ছে।


আমি ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে তাকালাম।


আমার প্রতিবিম্বটা স্পষ্টই আছে।

তবে… **পাশে আরেকটা ছায়া!**

যেটা বাস্তবে নেই।

কেউ যেন আমার কাঁধের উপর দিয়ে আয়নার ভেতর থেকে তাকিয়ে হাসছে—

ঠোঁটে রক্তচাপা হাসি, চোখে নিঃশব্দ বিদ্বেষ।


"ডালি... তুমি আয়নার কাছে এসো না।"

আমার গলা কাঁপে।

ডালিকে পিছনে সরিয়ে আমি নিজে সামনে এগিয়ে গেলাম।


আমি যখন হাতে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে আয়নার পেছনে তাকাতে গেলাম—

কিছুই নেই।

সাধারণ কাঠের দেয়াল, ধুলো জমা পর্দা।

কিন্তু আয়নায় আবার তাকাতেই... সেই ছায়াটা উধাও হয়ে গেছে!


আমি বিভ্রান্ত। মাথা ঘুরে উঠলো।


— "তুমি... তুমি বুঝতে পারছো না, কেউ আসলেই আমাদের দেখে।"

ডালি কাঁদছে। ওর মুখটা শিউরে উঠছে আতঙ্কে।


হঠাৎ করেই ডালির আচরণ বদলে যেতে লাগলো।


**ওর গলা বদলে গেল— গভীর, অচেনা এক কণ্ঠ।**

— “তুমি কথা দিয়েছিলে। আমাকে নিয়ে যাবে। ভুলে গেলে?”


আমি হতবাক!

— “ডালি? তুমি এটা কী বলছো?”

ওর চোখ দুটো এতক্ষণে লালচে। শ্বাস নিচ্ছে অস্বাভাবিক ঘন ঘনভাবে।

আমি ওর কাঁধে হাত রাখতেই ও আঁতকে উঠলো, ঠেলে দিল আমাকে।


— “ও আমার ছিল। ওর শরীর আমার ছিল!”

ওর ঠোঁট ফাঁক হয়ে উচ্চারণ করলো সেই নারীকণ্ঠ—

একটা গভীর আত্মার রাগ যেন উঠে আসছে।


**আমি পিছিয়ে গেলাম। এবার নিশ্চিত—ডালির মধ্যে কেউ ঢুকেছে।**


ঘরের বাতাস আরও ভারী, ঠান্ডা।


আমি বিছানার পাশ থেকে পুরোনো একটা কাঠের বাক্স বের করলাম।

এটা পিসিমার পুরোনো আলমারিতে ছিল।

পিছনে সাঁটানো কিছু কাগজপত্র, একটা পচা গোলাপ, আর কিছু ধুলোমাখা চিঠি।


চিঠিগুলো খুলতেই চোখ কপালে ওঠে।

**সবগুলো লেখা এক নারীর হাতে — যার নাম ‘মঞ্জুরা’।**


একেকটা চিঠিতে লেখা:


> “তুমি বলেছিলে, আমায় বিয়ে করবে।”

> “তোমার মায়ের ভয়েই তুমি পেছিয়ে গেলে?”

> “তোমার ঘরেই আমি নিজেকে শেষ করেছি।”

> “তোমার বিছানা, তোমার বউ— এখন আমার!”


আমার বুক ধক করে উঠলো।

এই ঘরে কেউ আত্মহত্যা করেছিল? আর সেই প্রেতাত্মা এখন ফিরে এসেছে?


ঠিক তখনই ডালি মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

— “আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে… মঞ্জুরা পানি চায়...”


চলবে....



0 Post a Comment:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন