(সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্প )
#মুখোশের আড়ালে
পর্বঃ২
চোখের সামনে ভেসে আসতে লাগলো প্রায় পাঁচ বছর আগে সবার অগোচরে ঘটা সেই ভয়ংকর ঘটনাটা।যেটার সাক্ষী ছিলাম আমি আমার মা আর একজন।যে ঘটনার ছোবলে আজকের আমার এই অবস্থা...
ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষার পরে,আমি তখন মায়ের সাথে নানুবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম..
আমি সবার খুব আদরের ছিলাম।আমার কারণে আমার তিন মামা নানুবাড়ির ছাদে পিকনিকের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো..আমরা সবাই মিলে ছাদে পিকনিক করছিলাম।কিন্তু আমার মা আসছিলো না উপরে...শরীর খারাপের কথা বলে মা নিচেই ছিলো।উপরে আসছিলো না।মায়ের শরীর খারাপ বলে,
আমরাও বেশি জোর করিনি।
পিকনিকের মাঝে আমার বাবা হঠাৎ করেই ফোন দিলো।ভিডিও কল দিয়ে দেখতে চাইলো তার আদরের মেয়েটা কি কি করছে মামাদের সাথে।
আমি খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাবাকে দেখাচ্ছিলাম।বাবা আমাকে বললো,
মায়ের কাছে ফোন নিয়ে যেতে।।আমিও বাবার সাথে কথা বলতে বলতে নিচে নেমে গেলাম,মাকে ফোন দিয়ে আসার জন্য।।নিচে নেমে মায়ের ঘরে মাকে পেলাম না।ঘুরঘুর করে এঘর ওঘর খুঁজতে লাগলাম।কিন্তু কোথাও মা নেই।বাবাকে বললাম,মাকে খুঁজে তারপর তোমাকে কল দিবো।
এটা বলার পরে মাকে খুঁজতে খুঁজতে নানুবাসার একেবারে কোণার ঘরে উঁকি দিলাম।দেখি সেই ঘরের দরজা দেওয়া।তখন আমার মনে হলো,মা ওঘরে আছে কিনা।আমি দরজায় কড়া নাড়তে লাগলাম মা মা বলে।আমার ডাকের মধ্যে শুনতে পেলাম,ভেতরের ফিসফিস করে কথা হচ্ছে।নিচে তো শুধু আমার মা ই ছিলো।ভেতরে আসলে কে কে??কার সাথেই বা কথা হচ্ছে।
আমার কেমন জানি মনে হলো।আমি আরো জোরে মাকে ডাকতে লাগলাম আর দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলাম।
কয়েক মুহুর্ত যাওয়ার পরে আমাকে চমকে দিয়ে আমার মা দরজা খুলে মুখ বের করলো।
আমাকে বিরক্তির সাথে জিজ্ঞাসা করলো-
"কি হয়েছে??এতো চেঁচাচ্ছি কেন...?"
আমি হা করে মাকে দেখলাম,মায়ের চোখে-মুখে পানি।চোখ দুটো টুকটুকে লাল।বোধ হয় খুব কেঁদেছে।মায়ের এই অবস্থা দেখে আমার মনের ভেতর উথাল পাতাল হতে থাকলো।আমি ভয় পাওয়া গলায় মাকে জিজ্ঞাসা করে উঠলাম--
"ও মা।মা..তুমি কাঁদছো কেন??
কি হয়েছে তোমার??"
মা আমার কথার কোন উত্তর দিলো না।কেমন জানি ক্ষিপ্ত চেহারা করে আমাকে বলে উঠলো--
"আমার কিছু হয়নি।যাহ,এখান থেকে।আর উপরে গিয়ে কাউকে বলবি না।আমি এই ঘরে আছি।"
এই প্রথম আমার মা এমন ব্যবহার করলো।আমার খুব কান্না আসছিলো।আমি হুট করেই মাকে কিছু না বলে শরীরের সমস্ত জোর দিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলতে গেলাম।আমার মা হয়তো ভাবেনি আমি এমনটা করবো।অনেকটা অপ্রস্তুতভাবে দরজা একটু খুলে যেতেই দেখি ভেতরে একটা লোক বিছানার উপর শুয়ে আছে।লোকটার দিকে চোখ পড়তেই,
সে কেমন জানি ভয় পেয়ে উঠলো।হুড়মুড় করে উঠে বসলো।আমি লোকটাকে এর আগেও কয়েকবার দেখেছি।কিন্তু এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না।আমি অবিশ্বাসের চোখ নিয়ে মায়ের দিকে তাকালাম।
মাও আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম,"লোকটা কে,লোকটা কে...?"মা সাথে সাথে আমার মুখে হাত চেপে ধরলো আর লোকটাকে কাঁপা গলায় বললো--
"তুমি এক্ষুণি বের হয়ে যাও শাহীন..."
এই কথা বলতেই ঘরের ভেতরে থাকা পেছন সাইডের দরজা দিয়ে লোকটা চোরের মতন পালিয়ে গেলো।
আমি পানিভর্তি চোখ নিয়ে সব দেখছি।আমার মা আমার মুখ চেপে রেখেছে,কিন্তু আমি এতোটুকু নড়াচড়া করতে চাইলাম না।
আমার মায়ের সাথে লোকটার কি সম্পর্ক?
কেন আমার মা এমন করছে??নানান প্রশ্নে আমি জর্জরিত।
লোকটা চলে যেতেই আমার মা আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো।আমি ভয়ে কান্না করে উঠলাম।মা সাথে সাথে ঘরের দরজা দিয়ে আমার কাছে আসলো।আমি ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম।আমার পুরো দুনিয়া ঘুরছে আমার সামনে।মা আমার পায়ের কাছে এসে বসতেই আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম,"লোকটা কে??এই ঘরে কেন তোমার সাথে ছিলো সে....?"
মা শংকিত মুখে আমার দিকে তাকালো।মায়ের চোখ দিয়ে অববরত পানি পড়ছে,মাথাটা একেবারে নিচু করা।ঠিক একটা অপরাধীর মতন।মা অঝোরে কেঁদে উঠলো।আমাকে বললো--
"আমি সব বলবো।তুই আমাকে ভুল বুঝিস না.।।"
এই কথাটা শুনে আমি কেমন জানি খুব রেগে গেলাম।আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম,"লোকটা কে...?আমাকে শুধু এটুকু বলো..."মা আমাকে দেখে উত্তর দিতে পারছিলো না।আমি অসহায়ের মতন কাঁদছি।মা আমাকে কি উত্তর দিবে।আমার যা বোঝার আমি বুঝে নিয়েছি।ঠিক সেই সময়ে ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হলো।বাইরে থেকে শোনা গেল,আমার ছোট মামা অনবরত আমাকে আর মাকে ডাকছে।।আমার দম বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো।আমি হুট করে উঠে এক দৌড় দিয়ে দরজা খুলে মামাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে গিয়েছিলাম।আমি কাঁদতে কাঁদতে খালি পায়ে বাসার বাইরে বের হয়ে গিয়েছিলাম।রাস্তার উপর বসে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম।
আমাকে খুঁজে বের করেছিলো আমার ছোট মামা।
ততক্ষণে আমার কান্না শুকিয়ে,মনের ভেতর প্রচণ্ড ক্ষোভ আর অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছিলো।আমি বাসায় ফিরে কারো সাথেই কিছু বলিনি।শুধু বলেছিলাম,আমি আমার বাবার কাছে যাবো।
অবস্থা এমন করে ফেলেছিলাম যে,আমাকে এক বেলার ভেতরেই আমার বাবার কাছে নিয়ে যাওয় হয়েছিলো।
ঐ ঘটনার পর থেকে আমার মা অনেকবার চেষ্টা করেছিলো আমার সাথে ওটা নিয়ে কথা বলতে।কিন্তু আমি তাকে কোনদিন সেই সুযোগ টা দেইনি।সেদিনের পর থেকে হাস্য-প্রাঞ্জল আমি একেবারের নিথর আর শান্ত হয়ে গিয়েছিলাম।।আমার মুখের হাসি দেখতে পেতো শুধু আমার বাবা।এক বাড়িতে থেকেও আমি আমার মায়ের থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে ছিলাম।প্রতিটা রাত আমি বিছানায় কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি মায়ের উপর অভিমানে।সকাল হলেই শক্ত পাথরের মতন ব্যবহার করেছি।।
আমি গোপনে অনেকভাবে জানার চেষ্টা করেছি,আমার মা সম্পর্কে।কিন্তু সবার কাছেই তার একটা খারাপ কথারও অভিযোগ পাইনি।কিন্তু সেই ঘটনা আসলে কি ছিলো,তা হয়তো আমাদের দুজনের ভেতরে অমীমাংসিত রহস্য হয়েই ছিলো।।
দরজায় কড়া নড়লো।বুকটা কেঁপে উঠলো...
বাবা ওপাশ থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো,
"নিশি,তোমার মাকে নিয়ে যাচ্ছি..দেখবে না..?"
আমি উত্তর দিলাম না...বাবা দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলো।আমার বুকটা ভীষণ ভারী হচ্ছে।
মায়ের চেহারাটা ভাসছে চোখে।পানি জমছে।
চোখ দুটো দু'হাত ধরে চেপে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমার ঘরে।কেউ কেউ জানলো না।কেউ শুনতে পেলো না।পাগলের মতন নিজেকে নিজে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি...শুধুই কাঁদছি....
আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
অনেক সাহস করে আস্তে আস্তে ঘরের বারান্দায় এগিয়ে গেলাম কি জানি দেখার জন্য।।হঠাৎ চোখ পড়লো,আমাদের গেটের এক কোণায় দাঁড়িয়ে সেই লোকটা কাঁদছে...আমার বুকের ভেতর কি জানি খুব জোরে বাড়ি দিয়ে উঠলো...মুহুর্তেই আমি কেমন জানি কঠিন হয়ে গেলাম।আমার সেদিনের প্রশ্নের উত্তর টা জানার খুব প্রয়োজন মনে হলো।আমি চোখ মুছেই কিছু না ভেবে এক দৌড় দিয়ে ছুটতে লাগলাম,লোকটার কাছে যাবো বলে...
গল্পঃমুখোশের আড়ালে
পর্ব (২)


0 Post a Comment:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন