হলুদ_শহরের পর্ব_২ সাহিত্য ডাইরি

হলুদ_শহরের 

পর্ব_২

সাহিত্য ডাইরি 




নিপুণ এক ব্যাগ বাজার নিয়ে বের হতেই দেখতে পেল কিছুটা দূরে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুপ্ত। চোখ-মুখ ফুলে কিছুটা লাল হয়ে আছে, যেন ঘুম থেকে উঠে সোজা এখানেই এসেছে। নিপুণ সুপ্ত'র দিক থেকে নজর সরিয়ে নিজ পথে হাঁটা ধরল।

সুপ্ত শাহবাগ থেকে ফিরেছে আটটা নাগাদ। মিনহাজ সাহেব ফজরের সময়ই তার ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিল। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হতেই দেখে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির দিকে আনমনে চেয়ে থাকার সময়ই হঠাৎ তার মাথায় শাহবাগ যাওয়ার ভূত চেপেছিল। বাবাকে ছাতার সাথে বাড়ি পাঠিয়ে দীপককে কল করে মসজিদের সামনে আনায়। ঘুম চোখে দীপকও ছুটতে ছুটতে এসে ব্যস্ত কণ্ঠে বলেছিল, 

--"কীরে? ইমার্জেন্সি ডাকলি কেন?"

সুপ্ত তখন বলেছিল,

--"শাহবাগ যাব, ফুল আনতে। চল।"

দীপকের তখন পুরো জন্মের রাগ একসাথে জড়ো হয়েছিল সুপ্তকে ঝাড়ার জন্য। শালা ফুল কিনতে যাওয়ার জন্য দীপকের এত সাধের ঘুমে জল ঢেলে দিলো? ফুল আনা কোনো ইমার্জেন্সি কাজের মধ্যে পড়ে? দীপকের ইচ্ছে হচ্ছিল বড়োসড়ো পাথর দিয়ে সুপ্তের মাথা ফাটিয়ে দিতে৷ দীপক অবশ্য থামেনি, পুরোটা পথ সুপ্তকে সে বকেই গেছে। আর সুপ্ত? সে তো যেন কোনো কথা কানেই নেয়নি। ময়লা ঝাড়ার মতো করে দীপককে এড়িয়ে গেছে। 

ফেরার পর সুপ্ত বাসায় গিয়ে ঘুম দিয়েছিল। আর দীপক মুখ ভার করে রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বেরিয়েছে। তার চোখে এই বেলায় আর ঘুম ধরা দিলো না। হাঁটা-চলার মাঝেই দীপক নিপুণকে দেখতে পেয়েছিল বাজারে যেতে। তখনই দীপক নিজের মনের ঝাল পুরো দমে মেটানোর পরিকল্পনা পেল। সুপ্তকে কল দিয়ে বাজে ভাবে তার কাচা ঘুম ভেঙে দেয়। সুপ্ত যখন ঘুম ভাঙার অপরাধে দীপককে গা*লি দিলো তখন দীপক যেন সমস্ত জগতের শান্তি নিজের ভেতর খুঁজে পেল। গালির চাইতে কারো ঘুম ভাঙানোর মতো পৈশাচিক আনন্দ আর কী-ই বা হতে পারে?

সুপ্তও চটে ছিল বেশ। পরপর দুবার তার ঘুমে ব্যঘাত ঘটেছে। দীপক অবশ্য বেশি সময় নেয়নি সুপ্তকে নিপুণের ব্যাপারে জানাতে। সুপ্ত নিপুণের কথা শুনে দমে যায়। ছুটতে ছুটতে চলে আসে বাজারের সামনে। সুপ্তর উষ্কখুষ্ক অবস্থা দেখে দীপক পেটে হাত চেপে হাসছিল। প্রেমে পড়লে বীরের মতো পুরুষরাও বেড়াল বনে যায়। প্রেমের কতটা শক্তি যে একজন কঠিন মানুষকে সরল করে ফেলে। 

নিপুণ সুপ্তর পাশ কেটে যেতে নিতেই সুপ্ত তাকে শুনিয়ে বলল,

--"একজনকে জানাচ্ছি শুভ সকাল। তাকে রোদহীন ম্লান দিনে সুন্দর লাগছে।"

নিপুণের পা থমকে যায় সুপ্ত'র কথা শুনে। কথাটা যে তাকে বলা হয়েছে তা নিপুণ হাড়ে হাড়ে বুঝে নিয়েছে। সে পিছ ফিরে সুপ্তের দিকে তাকালো। সুপ্তের ফোলা চোখ তখনো নিপুণের দিকে। নিপুণ চাইতেই সুপ্ত খোলা এক হাসি দিলো। নিপুণ বলে ওঠে,

--"সমস্যা কী আপনার?"

সুপ্ত অবাক হওয়ার ভান ধরলো। বলল,

--"আমার সমস্যা? কিসের, কোথায়?"

--"তাহলে প্রথমে ফুল আবার এখন আমাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলা, এসব কী?"

--"ফুল আমি দিয়েছি, এটা ঠিক। তবে আমি তোমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলেছি.. এর প্রমাণ কী? দীপক, আমি রিপোর্টার ম্যামকে কিছু বলেছি?"

দীপক হ্যাবলার মতো চেয়ে ছিল সুপ্ত'র দিকে। হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। তা দেখে সুপ্ত বলল,

--"যাহ, বাদ দে। তুই তো থাকিস অন্য খেয়ালে। নিপুণ, তুমি চাইলে ফ্রিতে তোমার বাড়ি অবধি বাজারের ব্যাগ পৌঁছে দিতে পারি।"

নিপুণ এতে কিড়মিড় চোখে তাকালো সুপ্তের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

--"আপনার মতো মানুষের থেকে উপকার পাওয়ার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই আমার নেই।"

নিপুণ চলে যেতে নিলে সুপ্ত পিছু ডাক দিয়ে বলল,

--"আমি কিন্তু থ্যাঙ্কিউ পাওনা আছি।"

নিপুণ থেমে পিছে ফিরে ভ্রু কুচকে তাকায়। সুপ্ত কিছু বলতে নিলে নিপুণ এবার আর না দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে যায়। নিপুণের সুপ্তকে এড়িয়ে চলা দেখে দীপক বলল,

--"তোকে তো পাত্তাই দেয় না।"

সুপ্ত একমনে নিপুণের যাওয়ার পানে চেয়ে আনমনে বলল,

--"এজন্যই তো তাকে ভালোবাসি।"

--"ডিভোর্সি মেয়ে তো তুই ডিজার্ভ করিস না সুপ্ত!"

সুপ্ত এবার চোখ লাল করে তাকালো দীপকের দিকে। সুপ্তের রাগ দেখে দীপক দমে গেল। সুপ্তের সামনে কিছুতেই "ডিভোর্সি" শব্দটা উচ্চারণ করা যায় না। সুপ্ত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

--"আর কখনো যাতে তোর মুখে এই শব্দ না শুনি।" 

সুপ্ত থেমে আবার বলল,

--"আজকে পার্টি অফিসে কোনো ঝামেলা নেই। এজন্য সাড়ে বারোটার আগে ভুলেও কল দিবি না। এবার কল করলে তোর হাতের ফোন ভাঙাচোরা অবস্থায় পাবি, গুড নাইট।"

সুপ্তের পুরো নাম মাহদী আরাভ সুপ্ত। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান সে। বাবা মিনহাজ সাহেব ব্যবসায়ী এবং তাদের থানার এক স্কুলের কমিটিতে আছে। সুপ্তের বড়ো ভাই মাহমুদ বিবাহিত, এখন অন্যত্র থাকছে চাকরির সুবাদে। মাহমুদ শুরু থেকেই কিছুটা ভীত এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ৷ আর সুপ্ত একদমই মাহমুদের বিপরীত। সে চরম ঝামেলা করার অদম্য সাহস নিয়ে জন্মিয়েছে। ঝামেলা, মাত্রাতিরিক্ত সাহস আর মুখ চালানোতে ভীষণ পটু সে। সুপ্ত চাকরি, ব্যবসার প্রতি ভীষণ উদাসীন। তবে উদাসীন ছেলেটার একটি স্বপ্ন ছিল; রাজনীতি করার। এজন্য ছাত্র বয়স থেকেই সে রাজনীতির সাথে একপ্রকার আঠার মতো লেগে আছে।

 মিনহাজ সাহেব একজন সৎ, শান্ত, নিষ্ঠাবান মানুষ হিসেবে এলাকার মানুষের কাছে পরিচিত। কিন্তু এই শান্ত মানুষের ঘরেই অসংখ্য বিচার এসেছে ছোটো ছেলের নামে। সুপ্ত বরাবরই অবাধ্য, চঞ্চল স্বভাবের ছেলে। তার মধ্যে আলাদা এক তেজ ছিল, যেই তেজের তীক্ষ্ণ ছায়াও কেউ মাড়াতে পারত না। মিনহাজ সাহেব যা অপছন্দ করেন সেটাই সুপ্ত আজীবন করে গেছে। আবার রাজনীতি বিষয়টাও তিনি ভীষণ অপছন্দ করেন। যতদিনে ছেলের ব্যাপারটা কানে আসল ততদিনে ঘটনা বহুদূর গড়িয়ে গেছে। সুপ্তকে মে*রে, ঘরে আটকেও দমিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। শেষমেষ মিনহাজ সাহেবের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। ছেলে যেই চতুর, বেপথে চলে যাবে সেই ভয়ও তাকে নাড়া দিচ্ছিল৷ এজন্য একপ্রকার বাধ্য হয়েই মেনে নিলেন, সঙ্গে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দিলেন যা সুপ্তের জন্য পালন করা খুবই কঠিন। তবুও সুপ্ত সেসব শর্ত দাঁতে দাঁত চেপে মেনে নিলো। কিন্তু একটা শর্ত সে কিছুতেই মানতে চায় না। ওই যে, মা*রপিটের ব্যাপারটা। তার ভাষ্যমতে মা*র-পিট না করলে তাকে কেউ ভয় পাবে না। ভয় না পেলে রাজনীতি করে কী লাভ? রাজনীতির মজাটা তো ওই ভয়েই আটকে আছে। তখন মিনহাজ সাহেব রেগে বলেছিলেন, 

--"মজা না লাগলে করবে না রাজনীতি। তাও মা*-রপিট বন্ধ।"

সুপ্ত তখন মুখ ভার করে বলেছিল,

--"আচ্ছা, ঠিক আছে। কাউকে মা*রলে তার ব্যথায় মলম দিয়ে দিব। তাতে চলবে?"

সুপ্তের এহেম কথায় মিনহাজ সাহেব হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলেন। সেই থেকে মিনহাজ সাহেব সুপ্তের সাথে ঠিক ভাবে কথা বলেন না। যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন। 

সুপ্ত দীপককে বলেছিল যেন কল না করে। সেখানে সুপ্ত নিজেই দীপককে কল করলো। দীপক কিছুটা চমকে গিয়ে কল রিসিভ করল,

--"হ্যাঁ, বল।"

--"জা*য়ার গুলারে খুঁজে পাইছিস?"

--"বিকালের মধ্যে খবর পেয়ে যাব।"

--"বিকাল কেন? ঘুম থেকে উঠেই ওদের আপডেট চাই। যেখানেই দেখবি মে* হাত-পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে আসবি। তবে হ্যাঁ, হাত-পা যাতে ভালো ভাবে ভাঙে। আমি তিন-চার মাস ওদের হাসপাতালে পড়ে থাকতে দেখতে চাই, গট ইট?"

সুপ্তের কথা শুনে দীপক শুধু অবাক হয়। আজ অবধি সুপ্ত যতবার মা*রার আদেশ দিয়েছে ততবারই সুপ্ত ওদের ব্যথায় মলমেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এত অদ্ভুত কেন এই সুপ্ত? এই সুপ্তকে পড়া ভীষণ কঠিন।

------------------

নিশাতকে কোচিং-এ পাঠিয়ে নিপুণ তড়িঘড়ি করে নিজের অফিসের দিকে ছুটেছে৷ আইডি কার্ডটা কোনো রকমে নিজের গলায় ঝুলিয়ে অফিসের লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এই বিল্ডিংটার পাঁচ এবং ছয় তলা মিলিয়ে নিপুণের অফিস। অফিসে প্রবেশ করতেই নিপুণ ম্যানেজারের থেকে বেশ কিছু কড়া কথা শুনলো। ম্যানেজার দেরী করে অফিস আসা পছন্দ করেন না। নিপুণ দাঁতে দাঁত চেপে ম্যানেজারের শুনে তাকে সরি বলল এবং জানালো সে আর দেরী করে আসবে না। সেদিনের মতো নিপুণ কড়া কথা শোনার পালা শেষ হলো। নিজের ডেস্কে গিয়ে বসতেই নিপুণের পাশের ডেস্কে বসা কলিগ রিয়া নিপুণকে ফিসফিস করে বলল,

--"বুড়োটারে মনে হয় বউ খেতে দেয় না। এজন্য বাড়ির রাগ এখানে আমাদের উপর এসে ঝাড়ে; বদ-জাত লোক।"

রিয়ার কথা শুনে নিপুণের স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। স্কুলে পড়াকালীন সময়ে যখন পরীক্ষা থাকত, তখন কোনো স্যার গার্ড বেশি দিলেই সহপাঠীরা নিজেদের মধ্যে বলত,

"স্যার মনে হয় বাসা থেকে ঝামেলা করে আসছে, এজন্যই আমাদের উপর এমন রাগ ঝেড়েছে।"

নিপুণ তখনো নীরব স্রোতা ছিল, এখনো আছে। সে রিয়ার কথা এড়িয়ে বলল,

--"বাদ দাও এসব, রিয়া। নিজের কাজ দেখো।"

রিয়া মুখ বাঁকিয়ে নিজের মনিটরের স্ক্রিনে নজর স্থির করলো। 

নিপুণের আজ নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় তেমন হলো না। নিত্যদিনের চাইতেও আজ বেশি কাজ পড়েছে তার। এর কারণ হয়তো অফিস দেরী করে আসা। এই পাঁচ তলায় মোট চার ডিপার্টমেন্ট কাজ করে। উপরে বাকি ডিপার্টমেন্টসহ খবর প্রচারের শুটিং স্পট রয়েছে।

 লাঞ্চের সময়ও আজ নিপুণ কাজ করছিল। এমন সময়ই তার স্থির ফোন ভাইব্রেশন করে ওঠে। নিপুণ ব্যস্ত হাতে টাইপিং-এর ফাঁকে একপলক তাকালো ফোনের স্ক্রিনে। নিশাত কল করেছে। নিশাতের কল দেখে নিপুণ ভ্রু কুচকালো, এই সময়ে নিশাত তো কখনো কল করে না। নিপুণ টাইপিং থামিয়ে নিশাতের কল রিসিভ করল।

--"হ্যাঁ, নিশাত। বল।"

--"বাবা কল করেছিল আপা।"

বাবার কথা শুনে নিপুণের মুখে যেমন আতঙ্ক ফুটে ওঠে, তেমনই গাম্ভীর্য। ভারী গলায় নিপুণ বলল,

--"হুঁ, তো?"

--"বাড়ির ঠিকানা চাইছিল।"


চলবে..................


বাবার কথা শোনার পর থেকেই নিপুণ কেমন অন্যমনস্ক, চুপসে গিয়েছে। কাজ ছাড়া কলিগদের সাথে এমনিতেও তেমন কথা বলে না। কিন্তু আজ কাজের কথা হুঁ, হা, না-তে সেরেছে। নিশাত কল করেনি এরপর। নিপুণ বিকালে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। কাজ আজ তুলনামূলক বেশি থাকা সত্ত্বেও কাজ সময়ের আগে শেষ করে ফেলেছে। সঙ্গে যতটুকু কাজ বাকি ছিল সেগুলো বাসায় করে নিবে।

বাসে উঠেই দুই সিট একসাথে খালি পেল নিপুণ। তাই সে দ্রুত জানালার সিটটা দখল করে নিলো। ক্লান্ত মুখে একটু দমকা হাওয়া ছুঁয়ে দিলেই নিপুণ বড্ড স্বস্তি অনুভব করে। জানালার কাঁচটা টেনে খুলতেই হুড়মুড়িয়ে বাতাস ছুঁয়ে যায় তাকে। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি কয়েক ঢোঁক গিলতেই নিপুণ অনুভব করলো তার পাশে কেউ বসেছে। নিপুণ মুখে পানি নিয়ে পাশে ঘুরে তাকাতেই দেখল পাশে সুপ্ত বসে আছে। সুপ্তকে দেখে অসাবধানবশত নিপুণের গলায় পানি কিছুটা আটকে যায়। যার ফলস্বরূপ মুখে থাকা সব পানি সুপ্তের মুখে গিয়ে ছিটকালো। সুপ্ত সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলেছে অধরজোড়া চেপে। পরপরই কানে ভেসে আসল অট্টহাসির শব্দ।

এরকম এক বাজে পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যাবে নিপুণ কল্পনাও করতে পারেনি। সে তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে রুমালটা বের করে সুপ্তের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

--"আমি অত্যন্ত দুঃখিত, এরকমটা হবে সত্যিই বুঝতে পারিনি।"

নিপুণের তখনো থেমে থেমে কাশি হচ্ছে। সুপ্ত দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়। কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে নিপুণের হাতের স্পর্শ পেয়ে সুপ্ত গলে যায়। সে সুন্দর করে রুমালটা দিয়ে নিজের মুখ মুছে নেয়। 

দীপকও বাসে উঠেছিল। সুপ্তের এ অবস্থা দেখে সে-ই ফিক করে হেসে দিয়েছিল। হাসতে হাসতে নিজ মনেই বলল,

--"আহারে বেচারা, প্রেম করতে গিয়ে যে কতকিছু সহ্য করতে হয়! সত্যি বস, তোর দারুণ ধৈর্য!"

সুপ্ত মুখ মুছে রুমালটা নিজের কাছে নিয়ে বলল,

--"এত বড়ো অকাজের জন্য রুমালটা আজ থেকে আমার হলো।"

সুপ্তের এ কথা শুনে নিপুণের মুখ থেকে দুঃখী ভাব উড়ে গেল। সে বোধহয় ভুলে গেছিল তার পাশে বসা লোকটি মোটেও সাধারণ ধাঁচের কেউ নয়। নিপুণ ভ্রু কুচকে বলল,

--"রুমাল দিয়ে কী করবেন?"

--"ভালোবাসার জিনিস যত্ন করে আগলে রাখব। রুমালটা এই মুহূর্তে আমার ভালোবাসা চাচ্ছে। ভালোবাসা দিতে আমি আবার কৃপণতা করি না।"

নিপুণের কুঁচকানো ভ্রু আরও কুচকে যায়। বিরক্তির শব্দ করে জানালার দিকে মুখ ফেরাল। মিনমিন করব বলল,

--"অসভ্য!"

--"কিন্তু আমি তো সভ্য। অসভ্যতামি কবে করলাম তোমার সাথে?"

নিপুণ চরম বিরক্ত হলো। আফসোস করলো কেন একে সরি বলল? পানি ফেলেছে ভালোই তো হয়েছিল। এখন যেন একদম মাথায় চড়ে আছে। নিপুণ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

--"চুপ থাকবেন প্লিজ? আপনার আজেবাজে কথা শুনে মাথা ধরেছে।"

সুপ্ত অল্প করে হাসলো। নিপুণকে বিরক্ত করতে তার ভীষণ ভালো লাগে। পাশাপাশি বসেও কম আনন্দ হচ্ছে না তার। সুপ্ত নিপুণের কানের কিছুটা কাছাকাছি মুখ নিয়ে আস্তে করে বলল,

--"টিপে দিব?"

নিপুণ গরম চোখে তাকাল। বাস এতক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। সুপ্ত আর জ্বালালো না নিপুণকে। সুপ্ত বাসের বাইরে থেকেই দেখেছিল নুপুণের মলিন মুখ। এজন্য জেনে-শুনেই বাসে উঠেছে সে। এখন নিপুণ রাগের চোটে যেন ভুলে বসেছে মন খারাপের কথা। যাক, এতেই সুপ্তের স্বস্তি।

কিছুদূর যেতেই সুপ্ত আবার মুখ খুলল,

--"নিপুণ, একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।"

নিপুণ ভ্রু কুচকে তাকায় সুপ্তের দিকে। সুপ্ত হেসে বলল,

--"সদর হাসপাতালে চারজন নতুন ছাগল ভর্তি হয়েছে। প্রত্যেকের হাত-পা ভাঙা। ছাগলদের সুন্দর রূপে দেখে আসতে চাইলে যেতে পারো।"

নিপুণের চোখ কপালে উঠে গেল সুপ্তের কথা শুনে। চারজন ছাগল আর গতকাল রাতের সুপ্তের দেওয়া হুমকি; সব যেন নিপুণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই নিপুণের চোখ-মুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে। অস্ফুট স্বরে বলল,

--"আপনি কী পাগল?"

--"ভালো কাজ করতে পাগল হওয়ার প্রয়োজন হয়?"

--"মা*-মা/রি ভালো কাজ?"

--"অন্তত খারাপ না। মেরে যদি খারাপ গুলোকে সোজা করা যায় তাহলে ক্ষতি কী? এছাড়া আমি ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদ বলে কথা, আমারও তো সমাজ সেবার কথা চিন্তা করা উচিত তাই না?"

--"এটাকে সমাজ সেবা বলে নাকি সমাজকে উস্কে দেওয়া বলে?"

সুপ্ত অকপটে বলল, "সমাজ সেবা।"

--"খারাপকে ভালো করার জন্য আইনি ব্যবস্থা আছে।"

সুপ্ত চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,

--"আমারও আইন আছে। নিজস্ব আইন।"

নিপুণ আর কথা বাড়ায় না। এই লোকের সাথে কথা বললে কথা খামাখা বাড়বে। নিপুণ আবারও বাইরে নজর ফেরালো। কেন যেন তার ভেতর সেরকম খারাপ লাগা কাজ করছে না। গতকাল যারা বাজে ব্যবহার করছিল তাদের একটা শাস্তি অন্তত দরকার ছিল। নিপুণ এতটাও উদার মনের কেউ নয় যে অন্যায়কারীকে নিয়ে চিন্তা করবে বা তাদের মাফ করে দিবে।

 সে শুধু শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে ঝামেলাহীন থাকতে চায়। কোনোরকম ঝামেলায় জড়াতে চায় না। এটাই শুধু তার ভয়। এছাড়া আর কিছু না। তবে সুপ্তকে যতটুকু চিনেছে সে সহজে নিপুণের কথা সবার সামনে আনবে না। নিপুণের হঠাৎ মনে পড়ে যায় সেদিনের ঘটনা। যেদিন সুপ্তকে সে চড় মেরে বসেছিল। সেই বোকামির কথা ভাবতেই নিপুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। 

নিপুণ বাড়ি ফিরতেই দেখল নিশাত দরজার খুলে সিঁড়ির আশেপাশে পায়চারী করছে। যেন সে নিপুণেরই অপেক্ষা করছিল। নিশাত তাকে দেখে খুশি হয়ে যায়। নিপুণ একপলক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জুতো খুলে নেয়। ভেতরে প্রবেশ করতে করতে নিশাতের উদ্দেশে বলল,

--"কী ব্যাপার নিশাত? আজ এত খুশি খুশি লাগছে যে?"

--"বলব, তার আগে ফ্রেশ হয়ে আসো!"

নিপুণ ফ্রেশ হতে চলে যায়। সন্ধ্যার জন্য হালকা-পাতলা নাস্তা বানাতে হবে। ফ্রেশ হয়ে, চেঞ্জ করে আসতেই নিপুণ দেখল দুই বাটি নুডুলস তার টেবিলের ওপর রাখা। নিশাত তার পাশেই অত্যন্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। নিপুণ অবাক হয়ে বলল,

--"কে দিলো নুডুলস?"

নিশাত মুচকি হাসে।

--"আমি বানিয়েছি আপা। তুমি যেভাবে কল কেটে দিলে তাতে মনে হচ্ছিল তুমি মন খারাপ করেছ। তাই ভাবলাম তোমাকে একটু খুশি করা যাক। ইভানের বড়ো ভাই দারুণ নুডুলস বানাতে পারে, আমাদের একদিন খাইয়েছিল। তার কাছেই শিখে নিয়েছি। আর ইউটিউবেও কিছু রেসিপি দেখেছি। এখন খেয়ে দেখো তো কেমন লেগেছে? উত্তেজনায় নিজেই টেস্ট করতে ভুলে গেছি।"

নিপুণ নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো ভাইটার দিকে। তার এই নিশাত যে বড়ো হয়ে গেছে তা তো সে খেয়ালই করেনি। ভাই এখন বড়ো বোনের হাসি-খুশির দিকটা খেয়াল রাখছে। সে কিসে খুশি, কিসে রাগ হতে পারে সেটাও ভাবে। নিপুণের চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। ইচ্ছে করছে ভাইটাকে জড়িয়ে ধরে বলতে, "তুই জগতের সবচেয়ে আদুরে ভাই নিশাত।"

ভাই-বোনের সম্পর্কটা খুব স্নিগ্ধ, সুন্দর হয়। এখানে যেমন ঝগড়া-ঝাটি, মার-পিট আছে তেমনই রয়েছে অন্তহীন ভালোবাসা, যা কেউ কেউ প্রকাশ করে আবার কেউ কেউ গোপন করে রাখে। নিপুণের চোখ-মুখে তৃপ্তি ফুটে ওঠে। ভাইকে নিয়ে বিছানায় বসে বলল,

--"একসাথে খাব চল।"

দুজন একসাথে খেতে বসেছে ঠিকই। তবে নিশাতের অনুরোধে নুডুলস প্রথমে মুখে পুরলো নিপুণ। নিশাত তখনো আগ্রহের সাথে নিপুণের মুখের দিকে চেয়ে। নিশাত বলল,

--"অনেস্ট রিভিউ দিবা আপা। আমি জানি কেউ-ই প্রথম ধাক্কায় ভালো রান্না করতে পারে না। সেখানে তো আমি নিতান্তই ছেলে মানুষ।"

নিপুণ ফিক করে হেসে দিলো। হাসি বজায় রেখে বলল,

--"ঝালটা বেশি হয়েছে আর লবণও পরিমাণমতো হয়নি।"

নিশাতের মুখ ভার হয়ে গেল। মিনমিন করে বলল,

--"ঝালের ব্যাপারটা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু ইউটিউব, ইভানের ভাই সবাই বলেছে স্বাদমতো লবণ দিতে। এখন তুমি-ই বলো আপা, প্রথম রান্নায় আমি কেমনে বুঝব লবণ কতটুকু লাগে? এদের কী কমনসেন্স নাই?"

নিপুণ আরেক দফা হাসলো। নিশাতের গাল টেনে বলল,

--"তবে সবকিছুর মধ্যেও একটা বিশেষ আইটেম আছে নুডুলসে।"

নিশাত চোখ জোড়া চকচক করে বলল,

--"সেটা কী আপা?"

নিপুণ মুচকি হেসে বলল,

--"আমার প্রতি তোর উপচানো ভালোবাসা।"

হাসা-হাসি, আড্ডার মাঝেই দুই ভাই-বোনের সময় কেটে যায়। নিপুণ চলে যায় রান্না করতে। রান্নার পাশাপাশি সে নিজের কাজগুলোও ল্যাপটপে টপাটপ করার চেষ্টা করলো। নিশাত পড়তে বসেছে। নিপুণ কী ভেবে নিশাতকে হাঁক ছেড়ে ডাকল।

--"নিশাত?"

নিশাত এক ছুটে রান্নাঘরে চলে আসল। নিপুণ নিশাতের উপস্থিতি টের পেয়ে রান্নায় মনোযোগ দিয়ে বলল,

--"বাবাকে কী ঠিকানা দিয়েছিস?"

--"না, দেইনি। জোর করেছিল, তোমার নাম্বারও চাইছিল। আমি কিছুই দেইনি।"

নিপুণ এবার গলা খাদে নামিয়ে বলল,

--"বকা দিয়েছে নিশ্চয়ই?"

নিশাত শুকনো হেসে বলল,

--"এ আর নতুন কী আপা? যাইহোক, ওনার গা*লি এখন আর গায়ে মাখি না। তুমিও চিন্তা করো না। সব ঠিক আছে।"

নিপুণ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। পুরানো তিক্ত, ভয়ংকর অতীত না চাইতেও তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত। শারিরীক এবং মানসিক ব্যথায় কাঁতড়ে থাকা দিনগুলো মাথায় আসলেই নিপুণের ভয়ে গা হিম হয়ে আসে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অনেক শক্ত মনোবল নিয়ে এখন নিজের জন্য, নিশাতের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে সে। এত সহজে নিপুণ সব এলোমেলো হতে দিতে পারে না। নিপুণের আর শক্তি নেই নতুন করে ভেঙে যাওয়ার। একজন মানুষ আর কত ভাঙবে, আঘাতপ্রাপ্ত হবে তাও কি না আপন মানুষদের দ্বারা?

নিশাত আবার বলল,

--"বাবা বলছিল আমাকেও ফিরে যেতে। কিন্তু সৎ মায়ের সংসারে আমি আর যেতে চাই না আপা। আমি তোমার সাথেই থাকব।"

নিপুণ আহত নজরে তাকায় ভাইয়ের দিকে। ভাইকে আশ্বস্ত করে বলল,

--"তুই আমার কাছেই থাকবি নিশাত, তোকে আমার থেকে আলাদা হতে দিব না কখনো। অন্তত ওই লোকের কাছে কখনোই তোকে ফিরতে দিব না, সেই ভরসা রাখ তোর আপার ওপর।"

--------------

রাতে নিপুণ ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে যেতেই তার ফোন টুং করে শব্দ করে উঠল। নিশ্চয়ই কোনো মেসেজ। নিপুণ ফোন চেক করতেই দেখলো একটা ছবি। সেই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালে পাশাপাশি দুইটা বেডে চারজন ছেলে আহত অবস্থায় পড়ে আছে। ছোটো বেডে দুজনের জায়গা হচ্ছে না বোঝাই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ না কেউ ঠিক পড়ে যাবে। এরকম এক দৃশ্য দেখে নিপুণ কীরকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করবে বুঝে উঠতে পারল না। ক্ষণিকের জন্যে যেন তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। পরপরই একটা মেসেজ আবারও শব্দের সাথে এলো। নিপুণ চোখ বুলালো মেসেজটার দিকে। সুপ্ত মেসেজে লিখেছে,

--"পকেটে তেমন টাকা নেই বুঝছ, তাই এদের জন্য আরেক জোড়া বেড ভাড়া নিতে পারিনি। এজন্য ভাবলাম একটা বেডই দুজন করে ভাগাভাগি করুক; এতে বন্ধুত্বের গভীরতা বাড়বে।

জানো, এই দৃশ্যটা বুকের বা পাশটায় খুব শান্তি দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে ফেসবুকে ছবিটা আপলোড করে বলি, 'আজকের দিনের সেরা ছবি', ড্যা~ম।"


হলুদ শহরের প্রেম

পর্ব ৪-৫

লাবিবা ওয়াহিদ


--"এ কী, নিপুণ? তুমি সত্যি সত্যি ছাগলগুলোকে দেখতে হসপিটাল চলে এলে?"

হাসপাতালের বিরাট বড়ো কেবিনে সারিবদ্ধ ভাবে দশটি করে মোট কুড়িটি বেড সাজানো। প্রত্যেক বেডেই রোগীরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত৷ 

আজ সকালেই একটি দুর্ঘটনায় বেশ কিছু আহত মানুষ হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। 

নিপুণ মূলত আরেকজন রিপোর্টারের সাথে হাসপাতালে এসেছিল সেসব পর্যবেক্ষণ করতে। কাজের ফাঁকে গতকাল রাতের ঘটনা মাথায় এসেছিল তার। সুপ্ত দুইজনকে একই বেডে রাখবে ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছিল না, কারণ যতদূর জানে হাসপাতালে এই ধরণের তেমন নিয়ম নেই।

 এজন্যই ব্যাপারটা সত্য নাকি মিথ্যে সেটা দেখতেই কলিগ রিপোর্টারের থেকে বিয়োগ হয়েছে সে। তবে এখানে এসে যা দেখলো তাতে তার চোখ ছানাবড়া! আসলেই এক জোড়া বেডে চারজন চাপাচাপি করে পাশাপাশি শুয়ে। একজন নার্সকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, এরকম কেন করতে দেওয়া হয়েছে? নার্স জবাব দেয়নি বরং এড়িয়ে গেছে। 

এমতাবস্থায় পাশ থেকে সুপ্তের গলা শুনে নিপুণ ভীষণ চমকে যায়। পাশ ফিরে চাইতেই দেখল সুপ্তকে। তবে পোশাকের দিক থেকে আজ তাকে ভিন্ন লাগছে। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরেছে সে। পাঞ্জাবির হাতা কনুই অবধি গুটানো। প্রতিদিনের এলোমেলো দেখা চুলগুলো আজ সুন্দর ভাবে গোছানো। সবশেষে মুখে কালো মাস্ক। মাস্কের আবরণে সুপ্ত থাকলেও সুপ্তকে চিনতে নিপুণের খুব একটা অসুবিধা হলো না। সুপ্তের নজর প্রতিবারের মতোই ইডিয়েট মার্কা। নিপুণ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

--"আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? আমি আমার ডিউটিতে আছি। একদম ডিস্টার্ব করবেন না।"

সুপ্তের চোখ জোড়া হাসলো যেন৷ সুপ্ত হঠাৎ বুক টানটান করলো। মুখ-ভঙ্গিতে গুরুতর ভাব এনে বেশ ভারী গলায় বলল,

--"আমিও ডিউটিতে আছি মিস রিপোর্টার। আপনার লজ্জা করছে না আমার সাথে লাইন মারতে? মেয়েরা যে এমন কেন, সুপুরুষ দেখলেই গায়ের সাথে লাগতে চলে আসে!"

সুপ্তের এহেম কথা শুনে নিপুণের চোখ কপালে উঠে গেল। বাক্যহারা হয়ে সে চেয়ে রইলো সুপ্তের দিকে। এগুলা কোন ধরণের কথা, নিপুণ কখন সুপ্তের গা ঘেঁষল? নিপুণ অস্ফুট স্বরে বলল,

--"মানে?"

সুপ্তের আর জবাব দেওয়া হলো না। দীপক এসে সুপ্তকে বলল,

--"কীরে, কই ছিলি? তোর কথা মতো সবই এনেছি। আয়, আহতদের পরিবার তোর জন্য অপেক্ষা করছে।"

নিপুণ শুনলো দীপকের কথা। সুপ্ত একপলক নিপুণের দিকে তাকিয়ে দীপকের সাথে চলে গেল। নিপুণ সেই ওয়ার্ড থেকে বের হতেই দেখল সুপ্তকে বেশ কিছু সাংবাদিকরা ঘিরে রেখেছে। সুপ্ত মাস্ক খুলে যথাসম্ভব তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে। নিপুণ সাংবাদিকদের মাঝে নিজের দুজন কলিগকেও দেখতে পেল। হঠাৎ নিপুণকে এসে ধরলো রিয়া। রিয়া নিপুণকে দেখে বলল,

--"কোথায় চলে গিয়েছিলে নিপুণ? শামিম ভাইয়া বলল তুমি তাকেও বলোনি।"

নিপুণ আমতা আমতা করে বলল,

--"আশেপাশেই ছিলাম।"

রিয়া সেভাবে ঘাটল না নিপুণকে। সামনে মাহদী আরাভ সুপ্ত রয়েছে। এজন্য তার বলা কথাগুলো শোনা বেশ জরুরি। তার কথার উপরই রিপোর্ট লিখতে হবে। এজন্য রিয়া নিপুণকে টেনে সেদিকেই নিয়ে গেল।

সুপ্তের মুখ-ভঙ্গি অস্বাভাবিক গম্ভীর। তার এই গম্ভীর ব্যক্তিত্ব নিপুণের কাছে সম্পূর্ণ নতুন-ই বলা চলে। এই লোক যে সামনের নির্বাচনের জন্য একজন প্রার্থী তা তার চলাফেরা কিংবা ত্যাড়া - বাঁকা কথাবার্তায় বোঝা দায়। এইযে এখন, কতটা প্রফেশনাল মুডে আছে সে। নিপুণ প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে এতে। 

হঠাৎ এক প্রশ্ন কানে এলো নিপুণের। একজন সাংবাদিক শুধালো,

--"আপনার নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন?"

নিপুণের কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে। এরকম একটা মুহূর্তে এই ধরণের প্রশ্ন? সুপ্ত অবশ্য এই প্রশ্ন এড়িয়ে গেল। সাংবাদিকদের বেশি সময় দিতে পারেনি সে। চলে যাওয়ার আগে ভীড়ের মাঝে নিপুণের ঘামে ভিজে থাকা মুখখানার দিকে একপলক চেয়ে সে চলে গেল। নিপুণ বিষম খায়, এই ভীড়ের মাঝে সুপ্ত তাকে দেখল কী করে? 

নিপুণ দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালের এদিক ওদিক ছুটল। একসময় কিছুটা সময় পেয়ে হসপিটালের করিডরে থাকা এক ফাঁকা আসনে গিয়ে বসল। ভীষণ ক্লান্ত সে। সকাল থেকে পেটেও কিছু পড়েনি। নাস্তা তৈরি করে নিশাতকে ডেকে ওঠাতে গিয়েই জরুরি কল এলো। দুর্ঘটনার কথা শুনে তাকে কোনোরকমে তৈরি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। ব্যস্ততার কারণে খাওয়ার মতো সময় হয়নি। এখন পেট জ্বলছে খুদোয়। অতীতে কত খালি পেটে থেকেছে সে। হয়তো সেই থেকেই দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকার অভ্যাসটা থেকে গিয়েছে। অতীত মাথায় নড়েচড়ে উঠতেই নিপুণ লম্বা কয়েক নিঃশ্বাস ফেলল।

নিপুণের সামনে দিয়ে মানুষজন ব্যস্ত পায়ে চলাচল করছে। এমতাবস্থায় কেউ একজন তার পাশে এসে বসল। নিপুণ পাশ ফিরে চাইতেই মাস্ক পরিহিত সুপ্তকে দেখতে পেল। সুপ্ত নিপুণের দিকে একমনে চেয়ে আছে। নিপুণ অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশে ভীত নজরে তাকাল। সুপ্ত কোন আক্কেলে তার পাশে এসে বসেছে? নিপুণ নিচু গলায় বলল,

--"আপনি এখানে কী করছেন?"

সুপ্ত নিপুণের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল,

--"তোমার মুখ এমন শুকিয়ে আছে কেন? কিছু খাওনি?"

নিপুণ কিছুটা থতমত খেল।

--"সেটা জেনে আপনার কাজ কী? আপনি আপনার কাজে যান।"

সুপ্ত ভ্রু কুচকে বলল,

--"কাজই তো করতে বসেছি। খাবে চলো।"

--"একদম না। জোরাজুরি করলে কিন্তু আমি উঠে চলে যাব। বিরক্ত করবেন না প্লিজ।"

--"উঠে যেতে গিয়ে যদি হাতে টান খাও তখন কী হবে ভেবে দেখেছ? চারপাশে এত মানুষ! দেখলে কী ভাববে বলো তো?"

সুপ্তের নরম গলার হুমকি শুনে নিপুণ চোখ বড়ো করে তাকাল। 

--"হুমকি দিচ্ছেন?"

--"কোথায়? আঙুল বাঁকাতে চাচ্ছিলাম। সোজা আঙুলে ঘি সচরাচর উঠতে চায় না তো!"

নিপুণ এবার চোখ রাঙালো। সুপ্ত তা তোয়াক্কা না করে কাউকে দিয়ে বিরিয়ানির প্যাকেট আনালো। সেটা নির্দ্বিধায় নিপুণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

--"হ্যাপি ফুডিং হার্ট।"

------------------------

নিপুণ ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলো। এক প্যাকেট বিরিয়ানি নিশাতের হাতে ধরিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। আজ তার রান্না করার শক্তি নেই, এজন্যই খাবার কিনে আনা। 

নিপুণ ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই জানালায় বৃষ্টির অনবরত ফোঁটা পড়ার শব্দ কানে এলো। বিকাল থেকেই আকাশ কেমন মেঘলা ছিল। নিপুণ সেসব তোয়াক্কা না করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ঘুমে জড়িয়ে যাওয়ার আগে নিশাতকে ডেকে বলে দিলো তাকে যেন না জাগানো হয়, সে খেয়ে এসেছে। 

ঘন্টা দুয়েক পর নিপুণ যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখনই ফোনের বিরক্তকর শব্দএ বেজে ওঠে। এতে নিপুণের ভ্রু কুচকে গেল। ঘুমটা ভাঙতেও বেশি সময় লাগল না। নিপুণ চোখ বুজেই ফোনটা হাতড়ে খুঁজল বালিশের পাশে। কোনোরকমে ফোনটা হাতে নিয়ে পিটপিট করে নামটা দেখে নিলো। অফিস থেকে কল। নিপুণ চোখ বুজেই কল রিসিভ করলো, সালাম দিলো। ওপাশ থেকে বেশ কিছু কাজ এলো। কাজের কথা শুনে নিপুণের না চাইতেও ঘুম কেটে গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসল সে। মাথা ধরে উঠে বসে মিনমিন করে বলল,

--"এগারোটার আগেই রিপোর্ট রেডি হয়ে যাবে স্যার। আমাকে ঘন্টাখানেক সময় দিন।"

কল কাটতেই নিপুণ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। ড্রিম লাইটের আলোয় দেখলো ঘড়ির কাঁটা নয়টার কোঠায়। নিপুণ একরাশ বিরক্তি নিয়ে বাথরুম থেকে মুখ ধুঁয়ে এলো। ঘুমের রেশ কাটাতে রুম থেকে বের হতেই দেখল নিশাত সোফায় এক পা তুলে কার্পেটে শুয়ে মোবাইল দেখছে। নিশাত নিপুণকে দেখতেই সেভাবে শুয়েই বলল, 

--"আপা, এত জলদি উঠে গেলা যে?"

--"কাজ আছে।"

এটুকু বলেই নিপুণ রান্নাঘরে চলে গেল চা বানাতে। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই সে রুমে চলে গেল। রিয়ার সাথে কলে কথা চালিয়ে যেতে যেতে সে একমনে ল্যাপটপে রিপোর্ট লিখল। আজ এগারোটায় তাদের ফেসবুক চ্যানেল থেকে লাইভ নিউজ টেলিকাস্ট হবে। অনলাইন মিডিয়া হওয়ায় এখানে এত আয়োজন নেই।

 নিপুণ রিপোর্ট লিখতে গিয়ে কিছুটা বিরক্ত হলো৷ রিপোর্টের একটা অংশ সুপ্তকে নিয়ে। সুপ্ত তাকে যখন বিরিয়ানি ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়, নিপুণ তখন চেয়েও বিরিয়ানিটা ফেলে দিতে পারেনি। এক সময়ে খাবারের জন্য সে যেই কষ্ট করেছে তাতে সে খাবারের মূল্য কত সেটা হাড়ে হাড়ে জানে। তাই তো সুপ্তের উপর রাগ থাকা সত্ত্বেও খাবারটা ঠিকই খেয়ে নেয়। এই অতিরিক্ত নিপুণের সান্নিধ্যে থাকা সুপ্তকে নিয়ে তার রিপোর্ট লিখতে হবে সেটা সে ভাবেনি কখনো। তাই কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলেই সুপ্তকে ঘিরে লেখা রিপোর্টটি সে সাবমিট করলো। 

ঘন্টাখানেকের মধ্যে সব ই-মেইল করে দিতেই আবারও ম্যানেজারের কল এলো। গম্ভীর গলায় বলল আগামীকাল একটু লেটেই সে যেতে পারবে। আর কাল হসপিটালও অন্যরা রিপোর্টের জন্য যাবে। নিপুণ কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সব গুছিয়ে পুণরায় লাইট নিভিয়ে শুতেই আবারও ফোনটা শব্দ করে উঠল। মোবাইল চেক দিতেই দেখল সুপ্তের মেসেজ। লিখেছে,

--"ক্লান্ত রিপোর্টার কী এখনো কাজ করছে? এত কাজ কিসের হুঁ, লাইট নিভিয়ে ঘুমাও। ক্লান্তির ছাপ সুন্দরীদের মুখে মানায় না। গুড নাইট হার্ট।"

নিপুণ এবার রাগের চটে রিপ্লাই না করে পারল না। টাইপ করল, 

--"রাত-বিরেতে অন্যের ঘরের লাইটের দিকে উঁকি দেওয়া ভালো না নেতা সাহেব। নিজের চরকায় তেল দিলে বেশি ভালো হয়।"

কিছুটা সময় নিয়েই সুপ্তের থেকে রিপ্লাই এলো,

--"নেতা সাহেব? তোমার মুখে এই সম্বোধন শুনতে আমি হাজারবার তোমার ঘরে উঁকি দিতে রাজি। শুধু উঁকি না, তুমি চাইলে তোমার বাসাতেও পৌঁছে যাব। 'নেতা সাহেব' শুধু তোমার, নিপুণ।"

নিপুণ নিজের দোষে নিজেই কপাল চাপড়ালো। মোবাইলটা বালিশের পাশে রেখে বিরক্তির সাথে "ধ্যাত" বলে উঠলো।


চলবে...............


বেশ কয়েকদিন কেটে যায়। নিপুণের দিনগুলো ব্যস্ততায় কাটছে তো আবার কখনো আবার ঝিম ধরে। তবে আলস্য সময় কাটানোর উপায় নেই। সে প্রতিনিয়ত যেভাবে পারছে সেভাবেই ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করছে। এইযে আজ, ছুটির দিন। বাসায় বসে না থেকে নিশাতকে নিয়ে বের হলো কোথাও ঘোরার উদ্দেশে। তাদের আশেপাশেই ঘোরার জায়গা আছে, সেসব জায়গাতেই ঘোরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। বিকালের দিকে ফিরে আবার রিপোর্ট লিখতে বসতে হবে।

রিকশায় বসে যখন নিপুণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে তখন নিশাত তাকে ঝাকায়। নিপুণ চমকে ভাইয়ের দিকে তাকাতেই নিশাত বলল, 

--"এসএসসির পর কোথায় পড়ব আপা?"

--"তোর সিদ্ধান্ত, তুই ভালো জানবি।"

নিশাত কিছুটা নীরব থেকে বলল,

--"আপা?"

নিপুণ তাকালো নিশাতের দিকে। নিশাত আমতা আমতা করে বলল,

--"আমার ক্রিকেট পছন্দ অনেক।"

--"তো খেলবি। বারণ তো করিনি।"

নিশাত দমে গেল। সে ঠিক কী বলতে চাইছে সেটা নিপুণ বুঝেও না বোঝার ভান ধরলো। ঘুরাঘুরির এক পর্যায়ে এসে যখন নিশাত নিপুণের সাথে ছবি তুলছিল তখন হুট করে নিপুণের পাশে এসে সুপ্ত দাঁড়ায়। নিশাত তাকে ফোনের স্ক্রিনে দেখে নড়তে চাইলে সুপ্ত তাকে থামিয়ে বলল,

--"একদম নড়বে না। ছবি ভালো আসছে, ক্লিক করো!"

নিপুণ সুপ্তের দিকে অবাক নজরে তাকাতেই নিশাত সুপ্তের কথামতো ফোনে ক্লিক করলো। ক্লিকটা জোরালো হওয়ায় পরপর ডাবল ক্লিক পড়ে যায়। নিপুণ চোখ রাঙিয়ে বলল,

--"এক্সকিউজ মি?"

সুপ্ত সোজা নিপুণের চোখের দিকে চেয়ে বলল,

--"জি ম্যাডাম?"

নিপুণ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, "আরেকজনের ছবির মাঝে ঢুকে যাওয়া কোন ধরণের ভদ্রতা?"

--"এটাকে অভদ্রতা বলে না। অধিকার আদায় করে নেওয়া বলে।"

নিপুণ কপাল কুচকে বলল, "আপনি এবং আপনার আজেবাজে কথা। নিশাত ছবি ডিলিট কর।"

নিশাত এতক্ষণ দুজনকে অবাক হয়ে দেখছিল। নিপুণের কথা ছবি ডিলিট করে নিলে সুপ্ত বলে ওঠে, "নো, নিশাত। আগে ছবিটা আমাকে হোয়াট'স আপ করো তারপর যা খুশি করিয়ো।"

নিপুণ এবার নিশাতকে চোখ রাঙিয়ে বলল, "খবরদার এরকম কিছু করবি না। দে দেখি আমাকে ফোন।"

নিপুণ নিশাতের হাত থেকে মোবাইল নেওয়ার আগেই সুপ্ত ছোঁ মেরে মোবাইলটা কেড়ে নেয়। এক গাল হেসে বলল,

--"সুন্দরীদের এত হাইপার হতে নেই ম্যাডাম, শ্বাসকষ্টের মতো রোগ হয়ে যায়। আমি তো আর ডাক্তার নই যে সারিয়ে দিতে পারব।"

বলতে বলতেই সুপ্তের ফোন হঠাৎ টুং শব্দ বেজে ওঠে। এর মানে তার ছবি আসা সফল হয়েছে। সুপ্ত নিশাতের ফোন ফেরত দিয়ে হাসি-মুখে বলল,

--"অন্য একদিন দেখা হবে নিশাত।"

সুপ্ত চলে গেল। শুধু খেপিয়ে দিয়ে গেল নিপুণকেই। সুপ্তের কাজকর্ম দিনদিন সহ্য সীমানার বাইরে চলে যাচ্ছে। ইচ্ছে তো করছে এখনই গিয়ে এর এসব কাণ্ড কারখানা রিপোর্টে গিয়ে লিখতে। এটলিষ্ট সবাই সুপ্ত'র ভালো মানুষির চেহারার ভেতরটা তো দেখতে পারবে। 

---------------------

মিনহাজ সাহেব মিনমিন করে কিছু একটা পড়তে পড়তে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। মিনহাজ সাহেবের স্ত্রী সাবিনা সুপ্তের রুম থেকে বেরিয়ে আসলেন। সুপ্তের শুকনো জামা-কাপড়গুলো ভাজ করে আলমারিতে রেখেছেন তিনি। সুপ্ত তার কাজ বাইরের কাউকে দিয়ে করাতে পছন্দ করে না। হয় নিজেই নিজের কাজ করে নয়তো তার মা তাকে গুছিয়ে দেয়। মিনহাজ সাহেব আড়চোখে স্ত্রীকে লক্ষ্য করে সরু গলায় বললেন, 

--"নবাব আজ কোথায় গিয়েছে তার খোঁজ-খবর জানো?"

সাবিনা মলিন চোখে তাকালেন স্বামীর দিকে। স্বামী যে তাকে স্পষ্ট খোঁচা দিয়েছেন সেটা তিনি হাড়ে হাড়ে বুঝে নিলেন। সাবিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 

--"হবে হয়তো, আশেপাশে।"

--"ওই আশেপাশেই থাকবে, আর মার-পিট করে বেড়াবে।"

--"কোথায় মারপিট করলো ও?"

--"করেনি কবে শুনি? তোমার লাই পেয়েই ছেলে এত মাথায় উঠেছে।"

সাবিনা এবার ভ্রু কুচকে বললেন, "লাই আমি একা দিলে এতদূর যেত না। আপনার এবং মাহমুদের লাইও পেয়েছে।"

মিনহাজ সাহেবও ভারী গলায় বললেন, 

--"আমি কবে লাই দিলাম? ওর কোন কথাটা আমি শুনেছি?"

--"না শুনলেও চুপ তো থেকেছেন! এইযে এখন, রাজনীতি তো আপনার অনুমতি নিয়েই করছে তাই না?"

মিনহাজ সাহেবের মুখ-ভঙ্গি শক্ত হয়ে এলো। স্ত্রীর সাথে এ প্রসঙ্গে কথা বাড়ায় না। গম্ভীর গলায় বললেন,

--"নবাবজাদাকে কল দিয়ে বলো যেখানেই থাকুক মাগরিবের মধ্যে যাতে মসজিদে থাকে। আমি মসজিদ যাচ্ছি।"

বলেই মিনহাজ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। সদর দরজার দিকে আগাতে নিলে সাবিনা তাকে থামিয়ে বলল, 

--"কলটা তো আপনিও দিতে পারেন। আর কত ছেলের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবেন?"

মিনহাজ জবাব দিলো না। দ্রুত বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। তখনই রান্নাঘর থেকে ছুটে এলো মাসুদা। হন্তদন্ত গলায় এসে বলল, 

--"তরকারিতে লবণ বেশি অইয়া গেছে খালাম্মা।"

সাবিনা বিরক্তির চোখে তাকালো মাসুদার দিকে। অল্প বয়সী মেয়ে মাসুদা। বয়স খুব সম্ভবত তেইশ চব্বিশ। বিয়ে করেছিল কিন্তু তার বর ভালো ছিল না বলে তালাক দিয়েছে। কোনো ছেলে-মেয়েও নেই। এভাবেই মানুষের বাড়িতে কাজ করে করে পেট চালায় সে। সাবিনা বিরক্ত গলায় বলল, 

--"রান্নাঘরে চলো।"

মাসুদা সহসা নিষেধ করলো। বলল,

--"লবণ আপনেই সামলান খালাম্মা। সন্ধ্যা অইয়া গেছে, বাড়িত যামু।"

সাবিনা ভ্রু কুচকে বলল,

--"কোথায় সন্ধ্যা হলো? সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে। ছয়টা পনেরোতে মাগরিবের আযান দিবে।"

মাসুদা তাও মানলো না। বলল,

--"আজকা আপনের বাড়িত আগে আইছি, তাই আগে আগেই আমার সন্ধ্যা অইয়া গেছে। খালুরেও দেকলেন না মাগরিবের নামাজে যাবে বলে চলে গেল? আমি তো পত্যেকদিন তার লগেই বাইরোই।"

মাসুদা থামলো। থেমে আবার বলল,

--"আমি যাই গা খালাম্মা। কালকা আবার আমু।"

মাসুদা কোমড় দুলিয়ে সাবিনার গায়ে একরাশ আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে চলে গেলো। সাবিনা মিনমিন করে বলল,

--"ফাঁকিবাজ মেয়ে! আগামীকাল থেকে মাহমুদের বাবাকে মাগরিবের নামাজের দশ মিনিট আগে বাসা থেকে বের হতে বলব।"

আজকের যুগে কাজের লোক পাওয়া খুবই মুশকিল। মাসুদা কয়েক বাড়িতে কাজ করে তাদের বাড়িতে আসে। তবুও কাজে ফাঁকিবাজি করে। সাবিনা একদিনও মাসুদার হাতে কাজ দিয়ে নিশ্চিন্তে বসতে পারেনি। সবসময় মাসুদার সাথে থেকে তাকে ধরে ধরে কাজ করাতে হয়। এসব ব্যাপারে সাবিনা যেমন বিরক্ত তেমনই ক্লান্ত। আর কত একা হাতে সংসার সামলাবে? সুপ্তটাও কথা শুনে না। সাবিনা কবে থেকে তাকে বলছে বিয়ের কথা, কানই দেয় না ছেলেটা। কিন্তু এবার তিনি এর হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন। আগামীকালই জোবেদাকে খবর পাঠাবেন। তিনি ভালোই ঘটকালি করতে পারেন। এখন তার ঘটকালি কতটা ভালো সেটাই সাবিনা দেখে ছাড়বেন।

-----------------------------

নিশাতের ফর্ম ফিলাপের টাকা জমা দিতে নিপুণ স্কুলে এসেছিল। স্কুলে চলাফেরা করতে গিয়ে হঠাৎ নিশাতের এক স্যারের সাথে দেখা হয়। মধ্যবয়সী স্যার নিশাতকে নিয়ে কথা বলতে আলাদা ডাকেন নিপুণকে। নিপুণ চিন্তিত হয়ে পড়ে এ কথা শুনে। নিশাতের পড়াশোনায় কী কোনো খামতি চলছে? স্যার কোনো অভিযোগ করবেন না তো নিশাতকে নিয়ে। স্কুল ভবনের বাইরে কিছুটা দূরে দাঁড়াল নিপুণ স্যারের সম্মুখে। স্যার নিপুণকে আচমকা বিব্রতকর প্রশ্ন করে বসলেন,

--"শুনলাম তোমার নাকি ডিভোর্স হয়েছে?"

আচমকা এরূপ প্রশ্নে নিপুণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নিপুণের চেহারায় সেই ভাব দেখে স্যার দ্রুত বললেন,

--"আরে, ভয়ের কিছু নেই। এভাবেই জিজ্ঞেস করলাম। একা ডিভোর্সী হয়ে নিশাতকে নিয়ে থাকছ এটা খুবই অবাকের ব্যাপার।"

নিপুণ সবসময় খেয়াল করেছে, 'ডিভোর্সী' শব্দটা তাকে কেমন দুর্বল করে ফেলে। এই দুর্বলচিত্তকে নিয়ে নিপুণ ভীষণ বিরক্ত। এই ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি তো সে কম হয়নি। তাহলে কেন এই একটি শব্দে নিজেকে বারবার আটকে ফেলছে? নিপূণ যথাসম্ভব নিজেকে সামলে বলল,

--"অবাকের কী আছে স্যার?"

স্যার কথা ঘুরালো। বলল,

--"কী করো তুমি?"

--"দেশী-বিদেশী অনলাইন মিডিয়ায় রিপোর্টিং-এর জব করছি।"

নিপুণ এবার ভালো ভাবে তাকালো স্যারের দিকে। স্যারের দৃষ্টিভঙ্গি হঠাৎ-ই কেমন বদলে গেল। নিপুণ স্যারের চোখে কাম দেখে নির্বাক হয়ে যায়। স্যার রসিয়ে রসিয়ে আরও কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু নিপুণ সেসব না শুনে সেখান থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করলো। কোনো রকমে স্যারকে এড়িয়ে বলল, 

--"আমার দেরী হচ্ছে, যেতে হবে স্যার।"

নিপুণ যেতে নিলে স্যার হঠাৎ নিপুণের হাত ধরে বসলো। কামুক নজরে নিপুণকে আপাদমস্তক পরখ করে বলল,

--"চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। কেউ জানবে না আমরা বিয়ে করেছি, আলাদা থাকব। মাসে মাসে ভালো খরচও দিব। দিব্যি ভালো দিন কেটে যাবে নিশাতকে নিয়ে।"

নিপুণ আঁতকে ওঠে এই ধরণের কথা শুনে। যতদূর জেনেছে এই স্যার বিবাহিত, ছেলে-মেয়েও আছে। তার চাইতেও বড়ো ব্যাপার এই লোক নিপুণের বাবার বয়সী। নিপুণ চোখ রাঙিয়ে লোকটাকে বলল,

--"হাত ছাড়ুন স্যার। আমাকে সিনক্রিয়েট করতে বাধ্য করবেন না। এটা স্কুল।"

লোকটা নিজের ধ্যান, হুঁশ একদম খুইয়ে বসেছে যেন। নিপুণের হাত না ছেড়ে বলল,

--"আমিও সিনক্রিয়েট চাচ্ছি না। চলো বিয়েটা সেরে ফেলি। তোমারও তো পুরুষ সঙ্গ প্রয়োজন তাই না? আমি দিতে রাজি।"

নিপুণের গা গুলিয়ে এলো এই ধরণের বাজে কথা শুনে। নিপুণ কিছু বলার আগেই তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো মিনহাজ সাহেব। মিনহাজ সাহেবকে দেখে স্যার চট করে নিপুণের হাত ছেড়ে দিলো। নিপুণ ঝাপসা চোখে তাকালো মিনহাজ সাহেবের দিকে। মিনহাজ সাহেব শক্ত চোখে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। স্যার আমতা আমতা করছে, কিছু একটা বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে মিনহাজ সাহেবকে। মিনহাজ সাহেব নিপুণের দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন,

--"তোমার নাম কী?"

নিপুণ আমতা আমতা করে বলল,

--"নিপুণ।"

--"নিপুণ মা, তুমি কাজে যাও। আমি ওর ব্যবস্থা করছি।"

নিপুণ একপলক চেয়ে দেখল স্যারকে। স্যার অসহায় মুখে মিনহাজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে। নিপুণ সেখান থেকে চলে গেলো। স্কুল থেকে বেরিয়ে একটি সিএনজিতে উঠে মুখে শাড়ির আঁচল চেপে কেঁদে ওঠে। এই ছোটো জীবনে তার আর কত কিছু দেখার বাকি আছে? সে যে এসব আর নিতে পারছে না। ধৈর্য ক্ষমতাও যে মলিন হয়ে আসছে।

মিনহাজ সাহেব এবার স্যারের দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললেন,

--"পুরুষ সঙ্গ প্রয়োজন তাই না?"

স্যার অত্যন্ত ভয় পেয়ে যায় মিনহাজ সাহেবের কথা শুনে। এর মানে কী তিনি সব শুনে ফেলেছেন। এ দিকটায় স্কুলের কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। লোকটা সেই সুযোগই কাজে লাগিয়েছিল। কিন্তু মিনহাজ সাহেব যে এভাবে চলে আসবে কে জানত? স্যার হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চাইলো মিনহাজ সাহেবের কাছে। বারংবার মিনুতি করলো। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। মিনহাজ সাহেব ক্ষমা করলেন না। উলটো দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

--"পাওয়াচ্ছি তোর নারী সঙ্গ।"

বেশ অনেকদিন পর সুপ্তের ফোনে মিনহাজ সাহেবের নাম্বার থেকে কল এলো। বাইকে গা এলিয়ে রেখেছিল সুপ্ত। কিন্তু বাবার নাম্বার মোবাইলে ভেসে উঠতেই সুপ্ত চট করে উঠে বসে। দীপক কিছুটা দূরেই বিড়ি টানছিল। সুপ্ত ডাকে দীপককে। দীপক বিড়িটা ফেলে সুপ্তের দিকে এগিয়ে আসে। সুপ্ত ফোনের দিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে বলল,

--"আজকে সূর্য কোন দিকে উঠেছে রে দীপক?"

--"কেন? কী হয়েছে?"

--"বাবা কল দিচ্ছে।"

অবাক হলো দীপক। 

--"তো ধর কল। ইমার্জেন্সি হতে পারে।"

সুপ্ত গলা পরিষ্কার করে কল রিসিভ করলো। সালাম দিলো বাবাকে। ওপাশ থেকে মিনহাজ সাহেব গম্ভীর গলায় সালামের উত্তর নিয়ে বলল,

--"একটা কাজ আছে তোমার জন্য। সেই কাজ দিয়েই আমি দেখতে চাই এতদিন কোন রাজনীতির বিদ্যা শিখেছ তুমি!"

কল লাউড স্পিকারে ছিল। মিনহাজ সাহেবের কথা শুনে দুই বন্ধুই চরম অবাক হলো। সুপ্ত অবাক গলায় বলল,

--"ব্যাপার কী আব্বু?"

--"এক জানোয়ারকে ধরেছি। স্কুলের একজন অসুস্থ মানসিকতার স্যার। চাকরি গেলেও এর মানসিকতা সুস্থ হবে না। তাই একে তোমার কাছে হস্তান্তর করছি। কঠিন মামলা দিতে পারবে তো?"

মিনহাজ সাহেব থেমে আবার বললেন,

--"খবরদার যদি এ বেলায় নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছ তো!"

সুপ্ত বলল,

--"কী করেছে সেটা তো আগে জানতে হবে!"

মিনহাজ সাহেব খুলে বললেন সবকিছু। এক ফাঁকে সে নামটাও বলে ফেলেছেন নিপুণের। নিপুণের নাম শুনে সুপ্তের কান দুটো যেন গরম হয়ে গেলো। দীপক দাঁত দিয়ে নখ কাটলো। বিড়বিড় করে বলল,

--"শালা, আর মেয়ে পেলি না হাত বাড়ানোর জন্য। কুমিরভরা খালে পা বাড়ালি, তুই তো শেষ।"


চলবে............

৩য় পর্ব

htttp//wwwthritpatstory.com


0 Post a Comment:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন