অন্তরঙ্গ আত্মরক্ষা
পর্ব ২(শেষ)
গিয়াস উদ্দিন আহাম্মাদ
রুদ্র ভাইয়ার কথায় পাখির গা জ্বলে উঠল। সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
*"আপনি যদি আমাকে এতই ঘৃণা করেন, তাহলে আমাকে বাঁচালেন কেন? আমাকে ওই পিশাচের হাতে মরতে দিলেই তো পারতেন!"*
রুদ্রের চোখে একটু নরম ভাব এল। সে পাখির কাঁধে হাত রাখতেই পাখি সজোরে সেটা ঝেড়ে ফেলে দিল।
*"ছোঁয়োনা আমাকে! একটা সৎবাবা নামের ভণ্ড আর আপনি— দুজনেই এক!"*
রুদ্র এবার গম্ভীর হয়ে বলল, *"শোন পাখি, আমি যা বলেছি, তা রাগের মাথায়। তুই জানিস, আমি কখনোই... ওই রকম কিছু চাইনি।"*
পাখির চোখে জল। *"তাহলে এত নিষ্ঠুর কথা কেন?"*
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, *"কারণ... আমি ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তুই হয়তো নিজেই চেয়েছিস... কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, কত ভুল ভেবেছি।"*
**◇◆◇**
পরের দিন সকাল। পাখি তার মায়ের ঘরে ঢুকতেই মা বিস্ময়ে বললেন, *"এতো সকাল সকাল? আর চোখগুলো এত লাল কেন?"*
পাখি কেঁদে ফেলল। সব কথা খুলে বলতেই মা হতবাক। *"এটা কি করে সম্ভব? সে তো... তোর বাবা!"*
*"না মা, সে কখনোই আমার বাবা নয়,"* পাখি দৃঢ়ভাবে বলল। *"আমাকে বিচার চাই।"*
**◇◆◇**
রুদ্র ভাইয়া পুলিশে রিপোর্ট করতে চাইল, কিন্তু পাখির মা ভয়ে বললেন, *"সমাজে মুখ দেখাবো কীভাবে?"*
পাখি এবার সাহস করে বলল, *"মা, দোষ আমার নয়। দোষ তার, যে নরপিশাচের মতো ব্যবহার করেছে!"*
রুদ্র সমর্থন দিল, *"পাখি ঠিক বলেছে। আমরা চুপ থাকলে সে আরও অনেককে ক্ষতি করবে।"*
**◇◆◇**
পুলিশ স্টেশনে গিয়ে যখন রিপোর্ট করা হলো, পাখির সৎবাবা চিৎকার করতে লাগল, *"এ সব মিথ্যা অভিযোগ! মেয়েটা নিজেই—"*
কিন্তু রুদ্রের জমা দেওয়া ভয়েস রেকর্ডিং (যে সে পার্টির রুম থেকে আগেই রেকর্ড করেছিল) সব প্রমাণ করে দিল। পাখির সৎবাবা গ্রেফতার হলো।
**◇◆◇**
বাড়ি ফেরার পথে রুদ্র হঠাৎ বলল, *"পাখি, আমি... আমার জন্য ক্ষমা চাই।"*
পাখি হেসে বলল, *"আপনি যদি আমাকে 'তুই' বলা বন্ধ করেন, তাহলে হয়তো ভাবা যাবে!"*
রুদ্র খিলখিল করে হেসে উঠল। *"ঠিক আছে, 'তুমি'ই হবে। কিন্তু একটা শর্তে—"*
*"শর্ত?"*
*"হ্যাঁ। তুমি... না, আপনি এখন থেকে শাড়ি পরবে ঠিকই, কিন্তু শুধু আমার সামনে!"*
পাখি লাল হয়ে গেল। *"রুদ্র ভাইয়া, আপনি এখনও সেই একই—!"*
রুদ্র হাসিমুখে বলল, *"মজা করছি। আসল কথা হলো... তুমি শক্ত হয়েছ। আমি গর্বিত।"*
পাখি মুচকি হাসল। অন্ধকারের পর আসে আলো— সে আজ তা বুঝতে পারল।
পাখির সৎ বাবার গ্রেফতারের পর পুরো পরিবারে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। মা সারাদিন চুপচাপ, রুদ্র ভাইয়া বাড়ির কাজকর্মে ব্যস্ত, আর পাখি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে বই আর গানের মধ্যে।
এক বিকেলে রুদ্র পাখির ঘরের দরজায় টোকা দিল।
*"খোলো, আমি... আমি কথা বলতে চাই।"*
দরজা খুলতেই পাখি দেখল, রুদ্রের হাতে দুটি চায়ের কাপ।
*"চা খাবি?"*
পাখি একটু হেসে বলল, *"এত ভদ্রতা? আপনি কি অসুস্থ?"*
রুদ্র গম্ভীর হয়ে বলল, *"না... শুধু ভাবলাম, তুমি হয়তো একা একা ভাবছ... আমি যদি—"*
*"যদি কিছু করতে পারেন?"* পাখি তীক্ষ্ণভাবে বলল, *"আমার সৎ বাবা জেলে আছে, মা আমাকে এড়িয়ে চলেন, আর আপনি এখন চা নিয়ে হাজির? কি চান আসলে?"*
রুদ্রের চোখে একটু ব্যথা ফুটে উঠল। *"আমি চাই... তুমি জানো যে আমি তোমার পাশে আছি।"*
**◇◆◇**
পরের দিন সকালে পাখি দেখল, তার মা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন।
*"মা?"*
মা ফিরে তাকালেন, চোখ লাল। *"মেয়ে, আমাকে ক্ষমা করো... আমি জানতাম না সে এমন—"*
পাখি মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, *"দোষ আপনার না, মা। দোষ একমাত্র তার, যে আমাদের বিশ্বাস ভেঙেছে।"*
মা পাখির হাত চেপে ধরে বললেন, *"আমরা দুজনেই শক্ত হবো, ঠিক আছে?"*
**◇◆◇**
কয়েক সপ্তাহ পর আদালতের দিন। পাখি সাক্ষ্য দিতে গিয়ে কাঁপছিল। রুদ্র পিছন থেকে ফিসফিস করে বলল, *"ভয় পেয়ো না। আমি এখানেই আছি।"*
যখন পাখির সৎ বাবা চোখ রাঙিয়ে তাকাল, রুদ্র এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলল, *"তোমার দিকে তাকিয়ো না। ওই নরপিশাচ তোমার দিকে তাকানোরও অযোগ্য।"*
পাখি গভীর শ্বাস নিয়ে সব বলল। বিচারক রায় দিলেন— ১০ বছর কারাদণ্ড।
**◇◆◇**
বাড়ি ফেরার পথে রুদ্র হঠাৎ বলল, *"পাখি, আমি একটা কথা ভাবছি..."*
*"কি?"*
*"তুমি কি কখনো ভেবেছো... আমরা... মানে..."* রুদ্র অস্বস্তিতে পড়ে গেল।
পাখি চোখ কচলিয়ে বলল, *"ওহ! রুদ্র ভাইয়া লজ্জা পাচ্ছে? এটা নতুন!"*
রুদ্র লাল হয়ে গেল। *"ছি ছি, এমন না! আমি শুধু বলতে চাইছিলাম... তুমি যদি কখনো... আমার সাহায্য চাও..."*
পাখি হাসতে হাসতে বলল, *"জানি, আপনি আমার পাশে আছেন। কিন্তু এখন থেকে 'তুমি'ই বলবেন, ঠিক আছে? 'আপনি' বললে মনে হয় আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন!"*
রুদ্র হেসে উঠল। *"তাহলে শোনো পাখি, আজ থেকে আমি তোমার... বন্ধু। সারাজীবনের।"*
পাখি মুচকি হেসে বলল, *"বন্ধুই থাকো। কিন্তু... এক কাপ চা দিতে ভুলো না!"*
**[সমাপ্ত]**
0 Post a Comment:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন